Globalization

গোড়ায় গলদ

ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখিলে এই বৃদ্ধি ভয়াবহ। কেন এমন ভাবে তাপমাত্রা বাড়িয়া গেল, সেই উত্তরটিও অজানা নহে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৭:৪৮
Share:

প্রতীকী ছবি।

দুনিয়ার পয়লা নম্বরে কলিকাতা। দুর্ভাগ্য, এই ক্রমসারণিটি কোনও গৌরবময় বিষয়ের নহে, ভয়ের। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ভয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) দুনিয়ার বেশ কয়েকটি শহর লইয়া সমীক্ষায় দেখিয়াছে যে, গত সাত দশকে শহরের গড় তাপমাত্রা সর্বাধিক বাড়িয়াছে কলিকাতাতেই। সেই বৃদ্ধির পরিমাণ ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখিলে এই বৃদ্ধি ভয়াবহ। কেন এমন ভাবে তাপমাত্রা বাড়িয়া গেল, সেই উত্তরটিও অজানা নহে। কলিকাতায় যাহা ঘটিতেছে, পরিবেশবিদ্যার পরিভাষায় তাহার নাম আরবান হিট আইল্যান্ড এফেক্ট। নগরায়ণের ফলে শহরে সবুজের পরিমাণ কমিয়াছে, মাটি ঢাকা পড়িয়াছে কংক্রিটের আস্তরণে। ফলে, তাহাতে তাপ আটকাইয়া পড়িতেছে, ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়িতেছে। সেই উষ্ণতা হইতে বাঁচিতে বাড়িতেছে বাতানুকূল যন্ত্রের ব্যবহার— তাহাতে যে কার্বন নিঃসরণ হইতেছে, তাহা উষ্ণায়নের মাত্রা আরও বাড়াইয়া তুলিতেছে। এক ভয়াবহ বিষচক্র সৃষ্টি হইতেছে। ঘটনাটি যে শুধু কলিকাতায় ঘটিতেছে, তাহা নহে— সমগ্র বিশ্বেই ইহা সমস্যা। কলিকাতার ক্ষেত্রে যাহা বিশেষ, তাহার নাম অসচেতনতা। এই শহর আড়ে-বহরে বাড়িয়া চলিতেছে পরিবেশের প্রতি বিন্দুমাত্র চিন্তা ব্যতিরেকেই। ফলে, কলিকাতাকে যদি বাঁচাইতে হয়, তবে চলতি পথটি পরিত্যাজ্য।

Advertisement

বাঁচিবার পথটি অজানা নহে। প্রথমত, শহর বলিতে যে শুধু কংক্রিটের জঙ্গলকে বুঝায় না, সেই পরিসরে সবুজের প্রয়োজন অনস্বীকার্য, এই কথাটি দ্ব্যর্থহীন ভাবে বুঝিয়া লইতে হইবে। ইহা সত্য যে, ভারতে শহরাঞ্চলের উপর জনসংখ্যার চাপ বিপুল। এবং ইহা অধিকতর সত্য যে, সেই চাপ সামলাইবার জন্য প্রথম কোপটি পড়ে গাছপালার উপর— বাড়ি তুলিতেও গাছ কাটা পড়ে, রাস্তা চওড়া করিতেও সবুজ ধ্বংস হয়। বস্তুত, শহরের আয়তন বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণতই চলে গাছ কাটিয়া। কিন্তু এই কথাটিও সত্য যে, ভারতের বহু শহরই সচেতন ভাবে এই সর্বনাশের পথ হইতে সরিয়া আসিয়াছে। কলিকাতার সম্মুখেও উপায়ান্তর নাই। নগরায়ণের প্রক্রিয়াটিকে বৃক্ষবান্ধব করিতেই হইবে। বর্তমান গাছগাছালি রক্ষা করা যেমন দরকার, তেমনই প্রয়োজন নূতন সবুজায়ন। অন্য দিকে, শহরকে কংক্রিটে মুড়িবার অভ্যাসটিও বর্জনীয়। শুধু গাছই নহে, তৃণাবৃত জমিও যে শহরের প্রয়োজন, এই কথাটি বুঝিতে হইবে। ইমারতের নকশা অনুমোদনের সময় খেয়াল রাখিতে হইবে, বাতাস চলাচলের পরিসর যেন থাকে। পরিবেশবান্ধব নির্মাণের বিজ্ঞান বহু দূর অগ্রসর হইয়াছে। তাহার ব্যবহার প্রয়োজন। তাহার জন্য বিশেষজ্ঞ গবেষণা সংস্থাগুলির সাহায্য লওয়া বিধেয়।

কলিকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলে নগরায়ণের প্রশ্নটি লইয়া সার্বিক ভাবেই ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন। শহরের নিকাশি ব্যবস্থা হইতে রাস্তার প্রস্থ, কোনওটিতেই কলিকাতা বিশ্বমানের কেন, দেশের অন্য বহু শহরেরও সমতুল্য নহে। এখনও এই শহরের নিকাশি ব্যবস্থা বহুলাংশে ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত পরিকাঠামোর উপর নির্ভরশীল। তাহার দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। কলিকাতার পূর্বে, দক্ষিণে, উত্তরে এবং গঙ্গার অপর তীরে শহর যে অঞ্চলগুলিতে বাড়িতেছে, সেখানে এই পরিকাঠামোর প্রতি অবহেলার কোনও অজুহাতই থাকিতে পারে না। কিন্তু, সেই বর্ধিত অংশের নাগরিক পরিকাঠামোও প্রাচীন শহরের ন্যায়। সামান্য বৃষ্টিতেই এক কোমর জল দাঁড়াইয়া যাওয়া তাহার একটি দৃশ্যমান উপসর্গ— অন্য বহু খামতিই আপাতদৃষ্টির বাহিরে থাকিয়া যায়। শহর গড়িতে হইলে প্রথম ধাপ তাহার পরিকল্পনার দিকে নজর দেওয়া। গোড়ায় যদি গলদ থাকিয়া যায়, তবে কোনও প্রসাধনিক সংস্কারেই শহরের ভাগ্য বদলাইবার নহে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement