প্রতীকী ছবি।
বাঙালি বিয়ের এক বিচিত্র রীতি— কন্যা বিয়ের আসরে আসে পানপাতায় মুখ ঢেকে। মেয়েদের বিয়ের বয়সের যে ছবি প্রকাশ পেয়েছে জাতীয় নমুনা সমীক্ষায়, তাতে রাজ্যবাসী মুখ লুকাবেন কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স একুশ, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় এক বছর কম। অর্ধেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় একুশ বছর বা তার আগেই। এই পরিসংখ্যান ২০১৯ সালের, অর্থাৎ এ হল করোনা অতিমারি শুরু হওয়ার আগের চিত্র। অতিমারিতে নাবালিকার বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং সমাজকর্মীরা বার বার অকালবিবাহের ঘটনাগুলির প্রতি সকলের নজর আকর্ষণ করেছেন। কিছু বিয়ে আটকানোও গিয়েছে, কিন্তু সংখ্যার বিচারে তা নগণ্য। সম্প্রতি স্কুল খুলতে আরও স্পষ্ট হয়েছে, কত মেয়ের আসন শূন্য। আজ সমীক্ষা করলে যে তথ্য মিলবে, তাতে বিয়ের গড় বয়স আরও কমে আসাই প্রত্যাশিত। অথচ, মেয়েদের অকালবিবাহ এবং শিক্ষাবঞ্চনা রুখতেই ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের সূচনার হয় ২০১৩ সালে। গত বছর দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ হয়েছিল এই খাতে। তবু বিয়ের বয়সের নিরিখে প্রকল্পহীন রাজ্যগুলির সমান পর্যায়ে পৌঁছতে পারল না পশ্চিমবঙ্গ।
মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় উৎসাহ দিতে সহায়তা ও অনুদানের যে প্রকল্পগুলি রাজ্য সরকার চালু করেছে, সেগুলি অগণিত মেয়ের জীবন স্পর্শ করেছে, সন্দেহ নেই। তবু বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যে পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল, তা আসেনি। অকালবিবাহ তার একটা লক্ষণ। অন্যগুলি হল জনসংখ্যায় কন্যাশিশুর অনুপাতে হ্রাস, নাবালিকার গর্ভধারণ, গার্হস্থ হিংসা, মেয়েদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চনা প্রভৃতি। রাজ্য সরকারের মুখপাত্ররা অবশ্য দাবি করছেন, কেবল বিয়ের বয়স দিয়ে সক্ষমতা মাপা উচিত নয়। বাংলার মেয়েরা ‘স্বাধীনচেতা’ বলে পালিয়ে বিয়ে করছে। নিজের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে পারা অবশ্যই মেয়েদের সক্ষমতার সূচক— কিন্তু না পালিয়ে মেয়েরা নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে পারছে না কেন? পশ্চিমবঙ্গে ‘অনার কিলিং’ নেই, সত্য। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে জাতপাতের পীড়ন নেই। স্বজাতির ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাঙালি পরিবারে এখনও সমান শক্তিশালী। নিজের বাড়িতে স্বাধীনচেতা মেয়ের স্থান নেই বলেই তাকে পালাতে হচ্ছে। অন্য দিকে, নিরাপত্তার অভাব বা তার বোধও বহু অভিভাবককে প্ররোচিত করছে মেয়েদের অতি অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিতে। তাতে আর কিছু না হোক, সেই মেয়েটির সুরক্ষার দায়িত্ব থেকে পরিবার নিষ্কৃতি পায়। দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু এটাই বাস্তব।
শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের তরফে দাবি করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিয়ে নথিভুক্ত হয় বলেই অন্য রাজ্যের তুলনায় তা বেশি দেখাচ্ছে। কথাটি সংশয়াতীত নয়। জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আঠারো বছরের পূর্বে বিয়ে হচ্ছে মাত্র চার শতাংশ মেয়ের। এই পরিসংখ্যান কি সত্যিই বাস্তবের প্রতিফলন? জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৯-২১) দেখিয়েছে, রাজ্যের ১৮ বছর বয়সি মেয়েদের চব্বিশ শতাংশ গর্ভবতী অথবা প্রসূতি। অতএব সক্ষমতার সূচক নিয়ে কালক্ষেপ করে কাজ নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের অধিকাররক্ষায় সরকার সচেতন হোক।