যাহা প্রচলনসিদ্ধ, তাহাকেই ‘স্বাভাবিক’ ধরিয়া লইবার মধ্যে বৌদ্ধিক আলস্যের উপস্থিতি প্রকট। কিন্তু, দুনিয়া সেই আলস্যের নিয়মেই চলে। ফলে, সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি নিতান্তই নারীকেন্দ্রিক হইলেও, সন্তানের পরিচিতির ক্ষেত্রে পুরুষের উপস্থিতিকে দুনিয়া ‘স্বাভাবিক’ বলিয়াই ধরিয়া লইয়াছে। হোমো স্যাপিয়েন্স নামক প্রজাতিটিকে যে হেতু অবশিষ্ট প্রাণিজগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন ভাবিবার কোনও জৈবিক কারণ নাই, কাজেই সন্তানের প্রসঙ্গে পিতার এই গুরুত্ব অ-স্বাভাবিক। তাহা প্রচলনসিদ্ধ, এই কথাটি অবশ্য সত্য। প্রচলনের ইতিহাসটিও বড় অল্প দিনের নহে। আদিম শিকার-কেন্দ্রিক জনগোষ্ঠী যে মুহূর্তে স্থিত হইল, কৃষিতে মনোনিবেশ করিল, ইতিহাসের সেই লগ্ন হইতেই ক্রমে— বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ধাপে— সন্তানের পরিচিতির সহিত পিতার পরিচিতির সম্পর্কটি অপরিহার্য হইয়া উঠিতে লাগিল। কিন্তু, আদিম প্রচলন মানেই যে তাহা অবশ্যপালনীয়, এই কথাটির বিরুদ্ধে লড়াই-ই মানবসভ্যতার অন্যতম চালিকাশক্তি। ইহাই আধুনিকতার বীজমন্ত্র। সুতরাং, সন্তানের ক্ষেত্রে মাতৃপরিচয়ই যথেষ্ট, পিতার পরিচয় না থাকিলেও চলে— এমন দাবি সভ্যতার নিয়মেই উঠিবার ছিল। গত কয়েক দশকে সেই দাবি উঠিয়াছেও বটে। নারীবাদের তৃতীয় প্রবাহ আবর্তিত হইয়াছে এই প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করিয়া। অবশ্য, তাহার পিছনে অর্থনীতির একটি বড় ভূমিকা রহিয়াছে। গত এক শতকে মহিলারা আর্থিক ভাবে সক্ষম হইয়াছেন— সন্তানের দেখভালের জন্য পুরুষের উপার্জিত অর্থের প্রয়োজন তাঁহাদের জীবনে কমিয়াছে। অন্য দিকে, কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতির অগ্রগতির ফলে সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুরুষের প্রত্যক্ষ জৈবিক ভূমিকাও আর অপরিহার্য নাই। কাজেই, মানব অগ্রগতির দীর্ঘ পরিপ্রেক্ষিতে দেখিলে নারীর একক মাতৃত্বের দাবিটি নিতান্ত স্বাভাবিক বলিয়াই প্রতিভাত হয়।
সমাজ অবশ্য এখনও সেই স্বাভাবিকতাকে স্বীকার করিতে নারাজ। কোনও নারী মা হইয়াছেন, অথচ সেই সন্তানের পিতৃপরিচয় অজ্ঞাত, এমন পরিস্থিতি তৈরি হইলেই সমাজের জিভ লকলক করিয়া উঠে, রসালো আলোচনার স্রোত বহিয়া যায়। কোনও এক নারী সমাজের বাঁধিয়া দেওয়া বৈবাহিক নিয়মের তোয়াক্কা না করিয়া আপন পছন্দের পুরুষসঙ্গীর সহিত যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হইতেছেন, এবং সেই ঘটনাটিকে গোপন করিবার পরিবর্তে সন্তান ধারণের মাধ্যমে তাহা ঘোষণা করিতেছেন; এমনকি সেই সঙ্গীটি কে, তাহাও জানাইতেছেন না, অর্থাৎ এক সঙ্গীর সামাজিক নিয়মকে সম্পূর্ণ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করিতেছেন— এই কথাটি হজম করা সমাজের পক্ষে এখনও কঠিন। অবশ্য, সব সমাজের পক্ষে সমপরিমাণ কঠিন নহে, তাহাও ঠিক।
কিন্তু, ইহাকেই চূড়ান্ত কারণ হিসাবে ধরিয়া লইলে ভুল হইবে। সন্তান উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ নারীকে কী ভাবে দেখিতে চায়, সেখানেই বিরোধের সূত্রপাত। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীকে দেখে একটি যন্ত্র হিসাবে— যে যন্ত্র সন্তান উৎপাদনে সম্পূর্ণ সক্ষম, কিন্তু তাহার কোনও নিজস্ব বিবেচনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা নাই, চেতনা নাই। যন্ত্রীর ইচ্ছাতে সন্তান উৎপাদন করা বা না-করাই তাহার কাজ। পিতৃতন্ত্র যন্ত্রীর ভূমিকায় স্বামী বা পরিবার বা গোষ্ঠীকে দেখিতেই অভ্যস্ত। অন্য দিকে, সচেতন নারী নিজের দেহের পূর্ণ অধিকার দাবি করেন। সন্তানধারণের প্রক্রিয়াটি নারীর শরীরের সহিত আক্ষরিক অর্থেই অঙ্গাঙ্গি। ফলে, সেই প্রক্রিয়াটির নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ অধিকার নারীর হাতেই থাকিবে— ইহাই সচেতন নারীর স্বাভাবিক দাবি। নারীবাদের প্রথম দুই প্রবাহের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল গর্ভপাতের অধিকারের। অর্থাৎ, নারীর অনিচ্ছায়, এমনকি ইচ্ছাতেও, শরীরে সন্তান আসিবার পরেও সেই সন্তান ধারণ না করিবার অধিকার দাবি করিয়াছিল নারীবাদী আন্দোলন। বহু ঘাত-প্রতিঘাত পার হইয়া সেই দাবি ক্রমে মান্যতা পাইয়াছে। নিজের শরীরের উপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাহা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তৃতীয় প্রবাহে নারীরা নিজেদের শরীরের উপর পূর্ণতর অধিকার দাবি করিতেছেন। তাঁহাদের শরীর যে পুরুষতন্ত্রের ব্যবহার্য যন্ত্র নহে, এই কথাটিকে দ্ব্যর্থহীন ভাবে প্রতিষ্ঠা করিবার পক্ষে একক মাতৃত্বের দাবিটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ। যে নারীরা এই অধিকারটি ব্যবহার করিবেন না, তাঁহাদের পক্ষেও এই অধিকারটির তাৎপর্য বিপুল। কারণ, প্রকৃত প্রস্তাবে এই দাবিটি মালিকানার। যাঁহার শরীর, তাঁহার মালিকানা। দাবিটি যন্ত্র হইতে পূর্ণ মানবীতে উত্তরণের। এই দাবি অস্বীকার করে, ইতিহাসের সেই সাধ্য কোথায়।
যৎকিঞ্চিৎ
গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি হয়েছিল, এবং রাম ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। রামের নেতৃত্বেই বানরসেনা পাঁচ দিনে রামসেতু বানিয়েছিল। আর তিনি যে দক্ষ মহাকাশচারী, সে তো পুষ্পক-প্রমাণিত। নাসা না জানলেও ব্রহ্মা জানেন। এ বার থেকে মধ্যপ্রদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়ারা রামায়ণ পড়বেন পাঠ্য হিসাবে, রামসেতু নির্মাণের প্রযুক্তি শিখবেন যাতে পাঁচ দিনেরও কম সময়ে সাগরসংগ্রাম সেতু বানানো যায়। আর কবির নামে যখন ‘তুলসী’, কথাই নেই। তুলসী তো ফলিত হিন্দু ঔষধি, মাহাত্ম্যবৃক্ষ, সীতাস্বরূপা।