ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ মিলিয়া শপথ লইয়াছে, ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ ৫৫ শতাংশ কমাইবে। প্রকৃত উদ্দেশ্য, ২০৫০-এর মধ্যে নেট নিঃসরণ শূন্যে নামাইয়া আনা। সেই অভিযাত্রায় এখনকার এই পরিকল্পনাকে বলা হইতেছে অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, আবার তাহা প্রশংসাও কুড়াইয়াছে। গ্রিনহাউস গ্যাস তথা কার্বন নিঃসরণে পৃথিবীকে দূষিত করিবার ‘অপরাধ’-তালিকার শীর্ষে যথাক্রমে চিন, আমেরিকা ও ভারতের স্থান। তাহারা যেখানে কার্বন নিঃসরণ কমাইতে পারিতেছে না, সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির নিঃসরণের পরিমাণ বৈশ্বিক নিঃসরণের মাত্র ৮ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও তাহারা দৃঢ় পদক্ষেপ করিতেছে— নিঃসন্দেহে প্রশংসার্হ। ‘কার্বন নিঃসরণ কমাইয়া ফেলিব’ বলিলেই হয় না, কমাইতে গেলে দেশের উৎপাদন, পরিবহণ, কলকারখানার দহন প্রভৃতি পরিসরে কার্বন নিঃসরণের ‘ব্যয়’ বাড়াইতে হইবে, কার্বনজাত জ্বালানিতে কর বসাইতে হইবে। স্বভাবতই ইহার ব্যাপক প্রভাব পড়িবে জনজীবন হইতে শিল্পক্ষেত্রে, তাহার আঁচ অর্থনীতির গায়েও লাগিবে। বাস্তবমুখী ও জনমুখী থাকিয়া, অর্থনীতির সুস্থিতি নিশ্চিত করিয়া কার্বন নিঃসরণ কমাইবার বিরাট চ্যালেঞ্জ লইয়াছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
মনে রাখা দরকার, যাহাদের কার্বন নিঃসরণ ৮ শতাংশ মাত্র, তাহারা ৫০ শতাংশ নিঃসরণ কমাইলেও অঙ্কের হিসাবে সার্বিক ভাবে নিঃসরণ কমিবে মাত্র ৪ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলিতেই পারিত, কার্বন নিঃসরণের মূল ‘অপরাধী’ যাহারা, সেই চিন ও আমেরিকা আগে কাজের কাজ করিয়া দেখাক। বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ২৭ শতাংশ চিন একাই করিয়া থাকে, আমেরিকা ১১ শতাংশ; তৃতীয় স্থানে থাকিলেও ভারতের কার্বন নিঃসরণ তুলনায় অনেক কম— মাথাপিছু নিঃসরণ আরও কম। আমেরিকা বিশ্ব-রাজনীতিতে বহুলাংশে কর্তৃৃত্ব ফলাইয়া থাকে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চিন ক্রমেই নিজের ওজন বুঝাইতেছে, কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিজেদের দায়বদ্ধতা দেখাইতে তাহাদের তৎপরতা চোখে পড়ে না। প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়া জো বাইডেন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত গুরুতর পরিস্থিতিতে আমেরিকার দায়িত্বের কথা জোর দিয়া বলিয়াছিলেন; গত এপ্রিলে আন্তর্জালিক জলবায়ু সম্মেলনে চিনা রাষ্ট্রপ্রধান শি চিনফিং বিশ্বের সব দেশ মিলিয়া ‘বৈশ্বিক পরিবেশ-প্রশাসন’-এর কথা বলিয়াছেন। কিন্তু কার্যকালে দেখা যাইতেছে, প্রতিশ্রুতি রক্ষার বা দৃঢ় পদক্ষেপ করিবার তাগিদ তাঁহাদের নাই। বরং কার্বন নিঃসরণ কমাইবার প্রশ্নে দক্ষ নেতার ন্যায় আগাইয়া আসিয়াছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন— যাহার দেশগুলির নিজেদের রাজনীতি বা অর্থনীতির সঙ্কট কম নহে, বিশেষত এই অতিমারিকালে। তাহাদের ভাবনা পরিচালিত হইতেছে এই বোধে: পৃথিবী একটিই; জলবায়ু পরিবর্তনে সমগ্র বিশ্ববাসী ভুক্তভোগী তাই দায়িত্ব সকলেরই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দায় কম হইতে পারে, দায়বদ্ধতা কম নহে। জলবায়ু সঙ্কট-মোকাবিলায় তাহাদের তৎপরতা বুঝাইল, নেতা তিনিই, যিনি পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝিয়া সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় কাজটি করিতে, ক্ষুদ্র স্বার্থগুলি দূরে সরাইয়া সর্বজনীন স্বার্থ রক্ষায় পিছপা হন না। শি চিনফিং বা জো বাইডেন-এর ন্যায় রাষ্ট্রনেতারা বিশ্বনেতৃত্বের এহেন সংজ্ঞা আত্মস্থ করিলে পৃথিবী উত্তাপে নহে, সমানুভবে উষ্ণ হইত।