ফাইল চিত্র।
আরও এক বার একই প্রশ্নের সম্মুখীন পশ্চিমবঙ্গ— গৌরী সেন কোথায়? সম্প্রতি যে রাজ্য বাজেট পেশ করা হইল, তাহাতে আয়ের তুলনায় ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেশি। লক্ষ্মীর ভান্ডার বা স্বাস্থ্যসাথীর ন্যায় প্রকল্পে ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়াছে অনেকখানি; আবার শিল্প, পূর্ত ইত্যাদি দফতরের বরাদ্দ বৃদ্ধির পরিমাণ যৎসামান্য— খাদ্য ও সরবরাহ দফতরের বরাদ্দ সটান কমিয়া গিয়াছে। তাহার পরও প্রায় পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকা ঋণ লইতে হইবে রাজ্য সরকারকে। ইহা সত্য যে, ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে ক্রমাগত ঋণ করিয়াও বিবিধ ব্যয়ের পথে সংসারের খরচ বাড়াইয়া চলা যতখানি গর্হিত কাজ, সরকারের পক্ষে ততখানি নহে। অর্থব্যবস্থার স্বার্থেও বটে, সাধারণ মানুষের কল্যাণকল্পেও বটে— প্রয়োজনে সরকার ঋণ করিয়াও খরচ করিতে পারে। কিন্তু, ঋণ করিয়া চলাকে অর্থোপার্জনের অপরিহার্য পন্থা করিয়া ফেলিলে মুশকিল। তেমন হইলে ঋণের বোঝা ক্রমেই বাড়িতে থাকে— প্রতি বৎসরই সুদে-আসলে ঋণ পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় টাকার অঙ্কও বাড়িতে থাকে। ফলে, যে সব খাতে অর্থব্যয় করা সরকারের কর্তব্য, সেখানে টান পড়ে। সেই ব্যয় নির্বাহের জন্য ফের ধার করিতে হয়। পশ্চিমবঙ্গ এই দুষ্টচক্রটির মধ্যে পড়িয়া আছে। তাহা হইতে নিস্তার পাইবার কোনও সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতের দিগন্তরেখায় নাই।
এই বৎসর হইতে সমস্যাটি জটিলতর হইবে, তেমন সম্ভাবনা বরং জোরদার। এই বৎসর জিএসটি ক্ষতিপূরণ প্রদানের মেয়াদ শেষ হইবার কথা। ২০১৭ সালে যখন দেশে জিএসটি ব্যবস্থা চালু করা হয়, তখন স্থির হইয়াছিল যে, এই নূতন ব্যবস্থায় যে রাজ্যে অন্তিম পণ্যটি বিক্রয় হইবে, কর আদায় করা হইবে সেই রাজ্যে— যে রাজ্যে পণ্যটি উৎপন্ন হইয়াছে, সেই রাজ্যে নহে। এই পরিবর্তনের ফলে রাজ্যগুলির মধ্যে কর আদায়ের অনুপাত পাল্টাইয়া যায়। কেন্দ্রীয় সরকার জানায় যে, পরবর্তী পাঁচ বৎসর সব রাজ্যে পরোক্ষ করপ্রাপ্তি যেন ন্যূনতম ১৪ শতাংশ হারে বাড়ে, তাহা নিশ্চিত করা হইবে। যে রাজ্যে রাজস্ব বৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশের তুলনায় যতখানি কম হইবে, কেন্দ্রীয় সরকার সেই ঘাটতি পূরণ করিয়া দিবে। পরিসংখ্যান বলিতেছে, অতিমারি এবং লকডাউনের কারণে অর্থব্যবস্থা ধাক্কা খাইবার পর এই ক্ষতিপূরণের উপর রাজ্যগুলির নির্ভরতা বাড়িয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। ২০২২ সালে যদি এই ক্ষতিপূরণ বন্ধ হইয়া যায়, তবে রাজ্যের আর্থিক সংস্থানের উপর তাহার নেতিবাচক প্রভাব পড়িবে।
ঋণও নহে, কেন্দ্রীয় ক্ষতিপূরণও নহে— রাজ্যের কল্যাণ কর্মসূচিকে চালাইয়া যাইতে হইলে রাজস্বের অধিকতর নির্ভরযোগ্য ও সুস্থায়ী উৎসের প্রয়োজন। তাহার একটিমাত্র পথ— রাজ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ বৃদ্ধি। তাহার প্রশস্ততম পথ শিল্পায়ন। জনকল্যাণের সহিত শিল্পোন্নতির যে কোনও বিরোধ নাই, বরং সাযুজ্য রহিয়াছে, এই কথাটি রাজ্যের কর্ণধাররা ইদানীং স্বীকার করেন। সে দিকে জোর দেওয়া প্রয়োজন। সকলের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা, বা মহিলাদের হাতে ন্যূনতম বুনিয়াদি আয়ের ব্যবস্থা করা, উন্নয়নের ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপগুলির গুরুত্ব বিপুল। কেরলের উদাহরণ বলিবে, শুধুমাত্র শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সরকারি লগ্নি অর্থব্যবস্থাকে কতখানি অগ্রসর করিয়াছে। কিন্তু, শূন্য রাজকোষে এই কাজগুলিও হয় না। এক কালে বামফ্রন্টের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত প্রতি বৎসর ‘ঘাটতিশূন্য বাজেট’ পেশ করিতেন। তাহাতে অর্থব্যবস্থার উপকার হয় নাই। এখন বাজেটে বাম জমানার ঋণ বা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের অসহযোগিতার কথা বলিলেও লাভ হইবে না। যাহাতে লাভ, সেই কাজগুলি করা বিধেয়।