Child Labour

বিপন্ন শৈশব

বিধানসভায় সম্প্রতি একটি প্রশ্নের জবাবে শ্রমমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে রাজ্যে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা যথাক্রমে ১৪, ৬, ৩, ১ এবং ২০২৪ সালে শূন্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:২৫
Share:

পশ্চিমবঙ্গে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা শূন্য, এমনই দাবি করলেন শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক। বিধানসভায় সম্প্রতি একটি প্রশ্নের জবাবে শ্রমমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে রাজ্যে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা যথাক্রমে ১৪, ৬, ৩, ১ এবং ২০২৪ সালে শূন্য। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, এই ‘শূন্য’ সংখ্যাটি কি শিশুশ্রমিক-শূন্যতা, না কি তথ্যশূন্যতা? এ রাজ্যের ইটভাটায়, বাজারে, বিড়িশ্রমে, ধাবায়, বাজি কারখানায়, খনি-খাদানে অনুসন্ধান করে একটিও শিশুকে কর্মরত অবস্থায় পাওয়া যায়নি, এ এক সংবাদ বটে। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর যত শিশু ভর্তি হয় প্রথম শ্রেণিতে, তার চাইতে চার-পাঁচ লক্ষ কম শিশু বসে মাধ্যমিক পরীক্ষায়। এতগুলি শিশুর এক জনও কোনও রোজগারের সঙ্গে যুক্ত হয়নি, কেবলই খেলাধুলা করে সময় কাটাচ্ছে, এ কথা মানা সহজ নয়। প্রশ্ন হল, রাজ্যে শিশুশ্রমিক কত, তা বোঝার কী উপায় গ্রহণ করেছে রাজ্য সরকার? যত দিন কেন্দ্রীয় সরকার শিশুশ্রমিকদের জন্য বিশেষ স্কুল চালিয়েছে, তত দিন প্রতি বছর শিশুশ্রমিকদের সমীক্ষা হয়েছে। ১৭ মার্চ, ২০২২ তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী বেচারাম মান্না বিধানসভায় জানিয়েছিলেন, জাতীয় শিশুশ্রমিক প্রকল্পের রাজ্যে ৩৬৩টি শিক্ষা কেন্দ্র চলছে, পড়ুয়া সাড়ে ষোলো হাজার। এর পর থেকে পরিস্থিতি কী, তা জানার উপায় নেই। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকার এই শিক্ষাকেন্দ্রগুলি উঠিয়ে দিয়েছে, নাবালক মজুরদের মূলস্রোতের স্কুলে আনার নির্দেশ দিয়েছে। তার ফলে শিশুশ্রমিক সমীক্ষাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যারা বিশেষ স্কুলে পড়ছিল তারা মূলস্রোতের স্কুলে গেল কি না, স্কুলশিক্ষার চৌহদ্দির বাইরে কত শিশু রয়ে গেল, সে প্রশ্নগুলির যথাযথ তথ্য পাওয়ার উপায় নেই। কোনও শিশুশ্রমিককে উদ্ধার করা হয়নি এ বছর, সে তথ্যও শিশুশ্রম-শূন্যতার প্রমাণ বলে পেশ করেছেন শ্রমমন্ত্রী। এখানেও প্রশ্ন ওঠে, উদ্ধার কাজ চালাতে কতটা তৎপর ছিল সরকার?

Advertisement

আইন অনুসারে চোদ্দো বছর বা তার কমবয়সি শিশুদের ‘শিশুশ্রমিক’ বলে গণ্য করা হয়। তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার দায় সরকারের। চোদ্দো থেকে আঠারো বছরের কিশোরদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আগে ছিল, এখন তুলে দিয়েছে কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গ সরকার অবশ্য উদাসীন। শ্রমমন্ত্রী বিধানসভায় বলেছেন, ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, ‘কন্যাশ্রী’, ‘যুবশ্রী’র মতো প্রকল্পের ফলে রাজ্যে যে আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি হয়েছে, তার জন্যেই পশ্চিমবঙ্গকে শিশুশ্রমিক-শূন্য করা গিয়েছে। এ সব দাবি উদ্বেগ তৈরি করে, কারণ সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে পরিসংখ্যান সংগ্রহ, বা নথিভুক্ত না করার প্রবণতা বড়ই প্রকট। ডেঙ্গির মতো সংক্রামক ব্যাধি থেকে শিশুশ্রমের মতো সামাজিক অন্যায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি পরিসংখ্যানে ঘাটতি এত বেশি যে আস্থা রাখা কঠিন।

সরকারি নথি অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে স্কুলছুট নেই, শিশুশ্রমিক নেই, দাসশ্রমও নেই। এর কারণ, বাংলা শিক্ষা পোর্টাল-এ প্রথম শ্রেণিতে প্রায় একশো শতাংশ শিশুর নাম তোলা হয়। তার পর সেই নামগুলিই ক্লাস থেকে ক্লাসে উঠতে থাকে, যত দিন না মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে দেখা যায়, তাদের অন্তত চল্লিশ শতাংশই বাস্তবে স্কুলে নেই। অনেকেই নানা কারখানা, ধাবা কিংবা অন্যত্র কাজ করছে। চেন্নাই-সহ নানা শহর থেকে পশ্চিমবঙ্গের নাবালকরা ‘দাসশ্রমিক’ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার হয়েছে, এখনও হচ্ছে। নাবালিকা বিবাহ, শিশু অপুষ্টি, পরিযায়ী শ্রমের আধিক্য, এগুলোও রাজ্যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কে আস্থা জাগায় না। অতএব শিশুশ্রম-শূন্যতার তথ্যকে প্রশ্ন করা চাই। আইনের সংজ্ঞা অনুসারে কতজন ‘শিশুশ্রমিক’ বলে গণ্য হল, সেই ফাঁক খোঁজা বৃথা। সরকারের কর্তব্য, প্রতিটি শিশুর শৈশব, কৈশোর সুরক্ষিত ও অর্থপূর্ণ করে তোলা। পশ্চিমবঙ্গে কত স্কুলছুট, কত শিশু কর্মনিযুক্ত, এখনই তার সমীক্ষা প্রয়োজন। এদের স্কুলে ফেরানোই সরকারের কাজ, এবং সমাজেরও।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement