সিবিআই খাঁচার তোতা, সুপ্রিম কোর্ট এই কথাটি বলেছিল ইউপিএ-র শাসনকালে। তোতাটি এখনও খাঁচাতেই বন্দি। সম্প্রতি দেশের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা এক বক্তৃতায় সিবিআই-সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার গতিপ্রকৃতি বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করলেন। ঘটনাক্রমে, বক্তৃতাটির আয়োজক ছিল সিবিআই! বিচারপতি রমণা বললেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে হলে রাজনৈতিক শাসকদের সঙ্গে সিবিআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের আঁতাঁত ভাঙতে হবে। তাঁর দাওয়াই, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে একটি বড়, সম্পূর্ণ ভাবে স্বশাসিত ছাতার নীচে একত্রিত করা হোক। সেই ছাতা-প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক শাসকদের নাগালের বাইরে থাকবে, ফলে তদন্তের কাজও নিরপেক্ষ ভাবে হতে পারবে। গণতন্ত্রের অতি দুর্ভাগ্য, দেশের প্রধান বিচারপতিকে প্রকাশ্যে স্মরণ করিয়ে দিতে হল যে, পুলিশবাহিনী কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতি নয়, সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ। কিন্তু, এই দুর্ভাগ্যকে নতমস্তকে স্বীকার করে নেওয়া ভিন্ন উপায় কী? বিরোধীদের নাজেহাল করতে যে ভাবে সিবিআই, ইডি বা আয়কর দফতরের মতো প্রতিষ্ঠানকে গত কয়েক বছরে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে এই প্রতিষ্ঠানগুলির উপর সাধারণ মানুষের আস্থা অবশিষ্ট নেই— থাকার কোনও কারণও নেই। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ দেখলেও স্পষ্ট হবে যে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি মূলত রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজেই ব্যবহৃত হয়। তবে, একই সঙ্গে উল্লেখ করা জরুরি যে, রাজ্যের অধীনে থাকা পুলিশবাহিনীও ঠিক একই ভাবে ব্যবহৃত হয়। ফলে, তদন্তের ভার কার উপর ন্যস্ত হচ্ছে, শুধু সেটুকু দেখেই মানুষ বলে দিতে পারেন যে, তার ফলাফল কী হতে চলেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলিকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে আসার প্রস্তাবটি নতুন নয়। কেন এই প্রস্তাব কখনও বাস্তবায়িত হয় না, তার কারণটিও সহজবোধ্য— রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকা কোনও দলই তদন্তকারী সংস্থারূপী অস্ত্রটিকে হাতছাড়া করতে চায় না। সমস্যার শিকড় সেই রাজনৈতিক ক্ষমতাতেই। দুর্ভাগ্য যে, কোনও রাজনৈতিক দলই দলের ক্ষুদ্র স্বার্থের বাইরে আর কিছু দেখতে আগ্রহী নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব তাদের কাছে কণামাত্রও নয়— যে কোনও মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখাই একমাত্র লক্ষ্য। তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে যদি সম্পূর্ণ স্বনিয়ন্ত্রিত কোনও ছাতা-প্রতিষ্ঠানের অধীনে নিয়ে আসা যায়, তা হলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রবণতা খানিক হলেও কমাই স্বাভাবিক। বিচারবিভাগে যেমন কলেজিয়াম ব্যবস্থার মাধ্যমে বিচারপতি নিযুক্ত হন, এই ছাতা-প্রতিষ্ঠানটিতেও তেমন ব্যবস্থার কথা ভাবা যেতে পারে।
কিন্তু, তাতেও সমস্যাটির মূলোচ্ছেদ সম্ভব হবে কি? ভারতের অভিজ্ঞতা বলছে, না। একটি বড় উদাহরণ নির্বাচন কমিশন। এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ স্বশাসিত। কিন্তু তার পরও প্রধানমন্ত্রীর দফতরের ডাকে যাবতীয় প্রথা ভেঙে সেখানে গিয়ে বৈঠকে বসতে কমিশনের আপত্তি হয়নি। কেউ দেশের বিচারবিভাগের উদাহরণও পেশ করতে পারেন। সাম্প্রতিক কালে একাধিক বার আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আদালতের নিরপেক্ষতার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রেখেও বলা প্রয়োজন যে, সেই প্রশ্নগুলি জনমানসে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলি স্বশাসিত ছাতা-প্রতিষ্ঠানের আওতায় এলেও যে কর্তারা রাজনৈতিক প্রসাদের প্রলোভন ত্যাগ করতে পারবেন, সেই নিশ্চয়তা আজকের ভারতে আছে কি? শাসকদের তুষ্ট রাখার অত্যুৎসাহ স্বনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ডকেও বিলক্ষণ নুইয়ে দিতে পারে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও, তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে স্বশাসিত ছাতা-প্রতিষ্ঠানের অধীনে নিয়ে আসার সংস্কারটি জরুরি, এবং অতি প্রয়োজনীয়।