প্রতীকী চিত্র।
কোভিড-১৯ অতিমারি যেন পতিতপাবন গঙ্গা! কেন্দ্রীয় সরকারের যাবতীয় পাপ যেন ধুইয়া মুছিয়া লইয়া গেল এই অতিমারি। অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য কেমন, এই প্রশ্নের উত্তর হইল, ভারত কোভিড-পূর্ব অবস্থায় পৌঁছাইয়া গিয়াছে। কর্মসংস্থানের পরিস্থিতির খোঁজ করিলেও একই উত্তর মিলে। গূঢ়ার্থ, অর্থব্যবস্থায় যত সমস্যা, সবই কোভিডের কারণে— এবং, কর্তাদের হাতযশে ভারত সেই সকল সমস্যা অতিক্রম করিয়া ফের কোভিড-পূর্ব সুবর্ণরেখা স্পর্শ করিয়াছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সত্যভাষণে যুধিষ্ঠিরতুল্য, এমন দাবি করিবার মতো ভক্ত বোধ হয় ভূভারতে নাই। কিন্তু, অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে আশ্বস্ত করিতে কোভিড-পূর্ব স্তরে পৌঁছাইয়া যাইবার কথা বলা এই সরকারের মাপকাঠিতেও বড় মাপের অনৃতভাষণ। ইহা এই কারণে মিথ্যা নহে যে, অর্থব্যবস্থা এখনও কোভিড-পূর্ব স্তরে ফিরিতে পারে নাই— সত্যই বহু মাপকাঠি প্রাক্-কোভিড স্তরে ফিরিয়াছে। ইহা এই কারণে মিথ্যা যে, সেই কোভিড-পূর্ব অবস্থাটি স্বর্গরাজ্য ছিল না। অতিমারি যদি না-ও আসিত, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা মুখ থুবড়াইয়াই পড়িত— কেন্দ্রীয় সরকার সেই ব্যবস্থা পাকা করিয়াই রাখিয়াছিল। অবস্থা কেমন ছিল, লুকাইবার উপায়মাত্র নাই— পরিসংখ্যান লইয়া যাবতীয় সরকারি যথেচ্ছাচারের পরও যেটুকু তথ্য পড়িয়া আছে, তাহাতে অর্থব্যবস্থার গায়ে ছোট-বড় ক্ষতের ছবি স্পষ্ট। তাহার পরও প্রধানমন্ত্রী হইতে অর্থমন্ত্রী বা তাঁহাদের আর্থিক উপদেষ্টারা হরহামেশা কোভিড-পূর্ব স্তরে ফিরিবার সন্তুষ্টি জ্ঞাপন করিয়া থাকেন কেন? দুর্জনে বলিবে, তাঁহারা ধরিয়া লইয়াছেন, জনগণকে বোকা বানাইতে আর সামান্য পরিশ্রমেরও প্রয়োজন নাই।
অতিমারি-পূর্ব ভারতে আর্থিক পরিস্থিতি কেমন ছিল, অর্থশাস্ত্রী কৌশিক বসু গোষ্পদে তাহার রূপ দেখাইয়াছেন একটি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে— অতিমারি আরম্ভ হইবার পূর্ববর্তী পাঁচ অর্থবর্ষের প্রতিটিতে আর্থিক বৃদ্ধির হার আগের অর্থবর্ষের তুলনায় কম ছিল। দেশ স্বাধীন হইবার পর আর কখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় নাই। অর্থাৎ, গতিভঙ্গ হইয়াই গিয়াছিল, অতিমারি আসিয়া বড় জোর খাঁড়ার ঘা-টি বসাইয়া দিয়াছে। অর্থব্যবস্থার গতিভঙ্গ ঘটিলে যে বিপদগুলি হয়, ২০২০ সালের মার্চের পূর্বেই তাহার প্রত্যেকটি ছিল ভারতের বাস্তব। যেমন, কর্মসংস্থানহীনতার হার অর্ধশতাব্দীতে সর্বোচ্চ; গ্রামাঞ্চলে প্রকৃত ভোগব্যয়ের পরিমাণ হ্রাস; বাজারে চাহিদার তীব্র অভাব ইত্যাদি। কোনওটিই অতিমারির কারণে ঘটে নাই, কারণ কালপর্যায়ে এই ঘটনাগুলি অতিমারির পূর্বসূরি। অর্থমন্ত্রী যে আশ্বাসবাণী বিলাইতেছেন, তাহার প্রকৃত অর্থ হইল, ভারত কায়ক্লেশে সেই ভগ্নদশায় ফেরত গিয়াছে। দিগন্তরেখায় অচ্ছে দিনের ইঙ্গিত নাই।
অতিমারির পূর্বেই এমন অবস্থা কেন হইয়াছিল, সেই কারণগুলি আরও এক বার স্মরণ করাইয়া দেওয়া জরুরি। ভারত ডুবিয়াছে মোদী সরকারের অপরিণামদর্শিতার ফলে। নোট বাতিল ও অপরিকল্পিত ভাবে জিএসটি প্রবর্তন, এই দুইটি ঘটনা অসংগঠিত ক্ষেত্রকে ধরাশায়ী করিয়াছিল— তাহার ফলে চাহিদাহ্রাসের রূপ ধরিয়া সংগঠিত ক্ষেত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিল। কেহ বলিতে পারেন, অতিমারি আসিয়া সেই ক্ষতি পূরণের অবকাশ দেয় নাই সরকারকে। কিন্তু, অতিমারি না আসিলেও পরিস্থিতি শুধরাইত, এমন ভরসা সরকারের আচরণ হইতে পাওয়া মুশকিল। কোভিড-এর আর্থিক প্যাকেজ হিসাবে সরকার যাহা ঘোষণা করিয়াছিল, প্রকৃতার্থে তাহা ছিল একগুচ্ছ মিথ্যাচার। এই বাজেটেও মূলধনি খাতে ব্যয়বরাদ্দ লইয়া অর্থমন্ত্রী যে ঢাক পিটাইয়াছেন, তাহার বাদ্যটিও মূলত অন্তঃসারশূন্য। মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে অর্থনীতির চাকা যে ঘোরে না, তাহা প্রশ্নাতীত।