সরকার-নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি দিতে সরকার নিজেই ব্যর্থ হচ্ছে।
এ যেন হিতে বিপরীত। কাজের দাবি মেটাতে গিয়ে শ্রমের অবমূল্যায়ন করছে রাজ্য সরকার, এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে তথ্য। পশ্চিমবঙ্গের এগারোটি জেলায় রাজ্য সরকারের নানা দফতরের প্রকল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি মেলেনি, অন্তত দু’টি জেলায় মিলেছে সরকার-নির্দিষ্ট মজুরির অর্ধেকেরও কম। কেন্দ্র একশো দিনের প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গের টাকা আটকে দিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ অনুসারে রাজ্য সরকারের নানা কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন জব কার্ড-ধারী শ্রমিকরা। কিন্তু জলপাইগুড়িতে তাঁরা দৈনিক ঊনষাট টাকা পেয়েছেন, মালদহে নিরানব্বই টাকা। অর্থাৎ, সরকার-নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি দিতে সরকার নিজেই ব্যর্থ হচ্ছে। ‘কিছু তো পাচ্ছে’— এমন যুক্তি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অচল। কী করে সরকারি প্রকল্পে নিযুক্ত শ্রমিক সরকারি হারের চেয়ে কম টাকা পায়, এ প্রশ্ন সরকারকে বিব্রত করতে বাধ্য— অবশ্য যদি লজ্জা পাওয়ার শক্তি সরকারের অবশিষ্ট থাকে। কেন কলকাতার নিকটস্থ জেলাগুলিতে মজুরির হার বেশি, আর প্রান্তিক জেলাগুলিতে কম? স্পষ্টতই, সরকার এখানে শ্রমের বাজারের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আর নেই, বরং বাজারের অন্যায্য বিধির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। যখনই একশো দিনের কাজের রূপায়ণের দায়িত্ব ঠিকাদারের হাতে দিয়েছে রাজ্য সরকার, তখনই এই পরিণাম অবধারিত হয়ে উঠেছিল। তবু জেলা প্রশাসন, অথবা সরকারি দফতরগুলি এ বিষয়ে যথেষ্ট নজরদারি করবে, শ্রমিকের অধিকার যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় তা নিশ্চিত করবে, এমন প্রত্যাশা ছিল। তার ছায়াটুকুও দেখা যাচ্ছে না— সরকারি ব্যবস্থায় মজুর সেই দরেই মজুরি পাচ্ছেন, যা তাঁরা খেতমজুরি, দিনমজুরি করে বাজারে পেয়ে থাকেন।
অথচ, একশো দিনের কাজের প্রকল্প শ্রমের বাজারে একটা সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিল, সে সত্য বহু সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়। অতিমারির সময় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য, কিন্তু এই প্রকল্প শ্রমিকের স্বার্থে এক অন্য, অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। প্রকল্প শুরু হওয়ার পরে দেশ জুড়ে শ্রমের মূল্য বেড়েছিল, গ্রামীণ অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল। পরবর্তী কালে প্রকল্পের সেই ইতিবাচক ভূমিকা অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, কারণ প্রকল্পের দৈনিক মজুরি যথেষ্ট বাড়ানো হয়নি। এখন অনেক রাজ্যে প্রকল্প-নির্ধারিত মজুরির হার রাজ্য সরকারের নির্ধারিত মজুরির চেয়ে কম। তা সত্ত্বেও, সরকারি মজুরিতে দরাদরির অবকাশ নেই, এবং একশো দিনের কাজে গতি থাকলে গ্রামীণ এলাকার নিয়োগকারীরা যথেচ্ছ হারে মজুরিতে বাধ্য করতে পারেন না শ্রমজীবী মানুষকে। তাই এ প্রকল্প শ্রমিকের বিপন্নতা অনেকটাই কমিয়েছিল। রাজ্য সরকারের ‘বিকল্প’ বস্তুত এই দু’দশকের প্রথাকে হেঁটমুণ্ড-ঊর্ধ্বপদ করছে। দরিদ্র, প্রান্তিক জেলায় সরকারও কম মজুরি দিচ্ছে, উন্নত জেলায় দিচ্ছে বেশি। ঠিকাদার আর সরকারের তফাত বোঝা যাচ্ছে না।
কাজ দেওয়ার যে কোনও প্রকল্পই যে জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিরাপত্তা প্রকল্পের বিকল্প হতে পারে না, ৬৬৪ কোটি টাকা খরচ করে রাজ্য সরকার এটুকু অন্তত বুঝে থাকলে, সেটাও লাভ। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের শর্ত মেনে, কেন্দ্রের টাকায় এবং সর্বভারতীয় পরিকল্পনার অধীনে যার রূপায়ণ করার কথা, তা সে ভাবেই করতে হবে। প্রকল্পের রূপায়ণে যে অনেক বিচ্যুতি ঘটেছে তা অনস্বীকার্য। কেন্দ্রীয় পরিদর্শকরা সরকারি প্রকল্পে নাবালক শ্রমিক পেয়েছেন, জব কার্ড ও মাস্টার রোলে গরমিল পেয়েছেন, তথ্য সরবরাহে বহু গলদও মিলেছে। রাজ্যবাসীর মধ্যে থেকেও এ সব অভিযোগ বার বার উঠেছে। এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সঙ্গে গ্রামের স্বউন্নয়নের সংযোগের মূল্য অপরিসীম। স্বচ্ছতা ও তৎপরতার সঙ্গে এর রূপায়ণ করাই রাজ্যের সামনে একমাত্র বিকল্প।