বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
একেবারে প্রথম স্থানটি অধিকার করতে পারেনি কলকাতা। তা দিল্লির দখলে। দ্বিতীয় হয়েছে কলকাতা। ভারতের শহরগুলির মধ্যে নয়, বৈশ্বিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, সবচেয়ে দূষিত বায়ু এই দুই শহরেই। যে সমীক্ষাটি হয়েছে, তাতে পিএম ২.৫ দূষণের চরম মাপ নয়, ব্যবহার করা হয়েছে পপুলেশন-ওয়েটেড অ্যাভারেজ— অর্থাৎ, শহরের জনসংখ্যা বেশি, তাই দূষণের পরিমাণও বেশি, এমন যুক্তি ব্যবহার করা চলবে না। বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড— কলকারখানা, যানবাহন ইত্যাদিতে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি। এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, রাজধানী শহর দিল্লির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ধুঁকতে থাকা কলকাতার কোনও তুলনাই চলে না, তবুও এই শহরের দূষণের মাত্রা দিল্লির সঙ্গে তুলনীয় হয়ে ওঠে কী ভাবে? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর, শহরের পরিবেশরক্ষার প্রশ্নে কলকাতার অভিভাবকদের সদিচ্ছার এবং উদ্যোগের পরিমাণ আরও কম। বায়ুদূষণ যে-হেতু চোখে দেখা যায় না, ফলে তার ক্ষতির পরিমাণটি বোঝা কঠিন। স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক, শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা থেকে ক্যানসার, হৃদ্রোগ, বহু প্রাণঘাতী অসুস্থতার জন্য বায়ুদূষণ প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী। এবং, বায়ুদূষণজনিত কারণে প্রতি বছর গোটা দুনিয়ায় চার কোটি মানুষ প্রাণ হারান— তাঁদের প্রতি চার জনে এক জন ভারতীয়। অসুস্থ হন তারও বহু গুণ বেশি মানুষ। এই অসুস্থতার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বিপুল; কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, এই বিপদের সামনে নাগরিক সম্পূর্ণ অসহায়। বায়ুদূষণ থেকে বাঁচার উপায় মানুষের নেই। ফলে, এই বিপদটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া রাজ্যের অপরিহার্য কর্তব্য।
অন্যান্য বিপদের মতো বায়ুদূষণের ক্ষেত্রেও দরিদ্র মানুষের উপর বিপদের বোঝাটি বিসদৃশ রকম ভারী। দূষণের নিরিখে প্রথম ২০টি শহরের মধ্যে সিঙ্গাপুর বাদে উন্নত দেশের আর কোনও শহর নেই। চিনের বেজিং এবং শাংহাই তালিকায় আছে, কিন্তু সে দেশ দ্রুত উন্নয়নশীল। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস বা টোকিয়োর তুলনায় ঢাকা, নাইজেরিয়ার লাগোস, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো-র কিনশাসা বা ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় দূষণের মাত্রা বেশি কেন, এই প্রশ্নটিকে উড়িয়ে দেওয়ার কোনও উপায় নেই। উন্নয়নশীল দেশের নগরায়ণের প্রক্রিয়াটিকে খতিয়ে দেখা জরুরি। শহরের মধ্যে রাস্তার অনুপাতে যানবাহনের সংখ্যা, যানজটের বহর, গণপরিবহণের যথেষ্ট ব্যবস্থা না থাকা; আবার শিল্পক্ষেত্রে শিথিলতর দূষণবিধি, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া— প্রতিটি জিনিসই দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এবং, শহরের অভ্যন্তরেও দায়বণ্টনের বৈষম্য অনিবার্য— যাঁরা ব্যক্তিগত গাড়িতে সফর করেন, তাঁদের দূষণের দায় সমান ভাবে বইতে হয় দরিদ্রতম মানুষকেও।
পরিবেশের প্রশ্নটিকে অস্বীকার করে, তার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক মঞ্চে দূষণ নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বটে, কিন্তু তাকে কাজে পরিণত করার চেষ্টা এখনও দৃশ্যমান নয়। বিশেষত নগরাঞ্চলের দূষণ প্রতিরোধে একটি সুনির্দিষ্ট ও সুসংহত নীতি প্রয়োজন। তাতে নতুন নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মবিধি যেমন থাকবে, তেমনই প্রয়োজন গণপরিবহণ নীতিরও। জোর দিতে হবে পরিবেশবান্ধব, পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের উপর। শহরের সেন্ট্রাল বিজ়নেস ডিস্ট্রিক্টে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের উপর কড়াকড়ি করা প্রয়োজন। সাইকেলের জন্য পৃথক করিডরের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অন্য দিকে, শহরে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। কলকাতা শহর গত কয়েক বছরে সম্পূর্ণ বিপরীতগামী হয়েছে। এই প্রবণতায় লাগাম পরানো প্রয়োজন। বাঁচার শেষ সুযোগটিও যাতে হাতছাড়া না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।