এ কথা এখন মোটের উপর স্বীকৃত যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে বেঁধে রাখতে বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে যাবতীয় প্রচেষ্টা চলছে কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং মিথেন গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যে। ঠিক তখনই এক সমীক্ষা জানাচ্ছে এ-যাবৎ নিঃশব্দে অব্যাহত থেকেছে আর এক শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ— নাইট্রাস অক্সাইড। ‘গ্লোবাল নাইট্রাস অক্সাইড বাজেট ২০২৪’ নামক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮০ থেকে ২০২০— এই চার দশকে এই গ্যাসের নিঃসরণ বেড়েছে চল্লিশ শতাংশ। রিপোর্টে এও জানা গিয়েছে, গত দশকে মোট নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণের ৭৪ শতাংশ এসেছে কৃষিকাজে নাইট্রোজেন এবং পশু সার ব্যবহারের ফলে। মনুষ্যক্রিয়ায় উদ্ভূত নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণ বর্তমান উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কার্বন ডাইঅক্সাইডের তুলনায় এই গ্রিনহাউস গ্যাসটির প্রায় ৩০০ গুণ বেশি উষ্ণায়নের ক্ষমতা থাকায় তা ঘোরতর উদ্বেগের কারণও বটে। বিজ্ঞানীদের দাবি, প্যারিস চুক্তি দ্বারা নির্ধারিত বিশ্ব তাপমাত্রার বৃদ্ধিকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অনেকটা নীচে বেঁধে রাখতে হলে ২০৫০ সালের মধ্যে নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসের নিঃসরণ অন্তত ২০ শতাংশ কমাতেই হবে। দুশ্চিন্তার আরও কারণ, বিজ্ঞানীদের মতে বর্তমানে এমন প্রযুক্তি তৈরি হয়নি যা এই গ্যাসকে বায়ুমণ্ডল থেকে সরাতে পারে।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রাসায়নিক নাইট্রোজেন সারের বিকাশ কৃষিক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করে, যা খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে ক্রমবর্ধমান বিশ্ব জনসংখ্যার খাবারের জোগান দেয়। তবে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, কৃষিজমিতে যতখানি নাইট্রোজেন সার দেওয়া হয়, তার অধিকাংশই বায়ুমণ্ডলে মিশে যায় নাইট্রাস অক্সাইড হিসেবে। এক বার নিঃসৃত হলে এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলে অবস্থান করে মানুষের গড় জীবদ্দশার থেকেও বেশি সময় ধরে। ফলে পরিবেশ এবং ওজ়োন আস্তরণের উপরে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে। শুধু তা-ই নয়, কৃত্রিম নাইট্রোজেন সার এবং পশু সারের অদক্ষ ব্যবহারের জেরে দূষিত হয়েছে ভূগর্ভস্থ, পানীয় এমনকি উপকূলবর্তী জল তথা জলাশয়। অন্য দিকে, মাংস এবং দুগ্ধজাত পণ্যের ক্রমাগত চাহিদা বাড়ার কারণে সার উৎপাদন বৃদ্ধি তথা পশুখাদ্য উৎপাদনেও নাইট্রোজেন সারের অতিরিক্ত ব্যবহার এই নিঃসরণে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি বা রাসায়নিক শিল্পক্ষেত্রের নিঃসরণ ততটা না পাল্টালেও, কৃষিক্ষেত্র থেকে নিঃসরণ বেড়েই চলেছে।
নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণে চিনের পরেই বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত, যেখানে নাইট্রোজেন সারের ক্ষেত্রে প্রায় আশি শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয়। এমনিতেই খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণ পুরোপুরি রদ করা সম্ভব নয়। বরং সে ক্ষেত্রে লক্ষ্য হওয়া উচিত নাইট্রোজেনের দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে নিঃসরণ হ্রাস। ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বহু দেশ নাইট্রোজেন সারের দক্ষ ব্যবহার, খনিজযুক্ত সারের বদলে জৈবিক সারের প্রয়োগ, উন্নত সার ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক নাইট্রাস অক্সাইড নিরোধক বিকল্প শস্যের উৎপাদনের মতো পদক্ষেপ করতে সফল হয়েছে। তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ না করে ভারত কি ‘কেবল ঘুমায়ে রয়’?