দুই সাংসদের প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম প্রতিমন্ত্রী যে তথ্য পেশ করলেন, দেশবাসীর তাতে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড়। জানা গেল, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে তেলের উপর শুল্ক বাবদ কেন্দ্রীয় সরকারের রাজকোষে এসেছিল ৪.৫৫ লক্ষ কোটি টাকা, পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪.৯২ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৯-২০’তে এই বাবদ সরকারের আয় ছিল ৩.৩৪ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ, যে বছর ভারতীয় অর্থব্যবস্থার সঙ্কোচন ঘটেছিল ৭ শতাংশ, সে বছরই পেট্রল-ডিজ়েলে শুল্ক বাবদ কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব টাকার অঙ্কে বাড়ল ৩৬ শতাংশ। স্পষ্টতই এই খাতে অস্বাভাবিক চড়া হারে রাজস্ব আদায় করেছে কেন্দ্র, এবং তার সিংহভাগ বিশেষ আমদানি শুল্ক ও সেস হওয়ার কারণে রাজ্যগুলিও তার ভাগ পায়নি। যদিও, এই বছরগুলিতে পেট্রোপণ্য খাতে রাজ্যগুলির রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও নেহাত কম নয়। কেন এত চড়া শুল্ক আদায় করতে হল, এই প্রশ্নের নির্বিকল্প উত্তর মিলবে যে, সরকারি ব্যয়নির্বাহ করার জন্য রাজস্ব প্রয়োজন, বিশেষত অতিমারির কারণে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আরও রাজস্ব প্রয়োজন। যদি প্রশ্ন করা হয় যে, এখন কেন জিএসটির হার বাড়ানো হল, বহু নতুন পণ্যকে জিএসটির আওতায় নিয়ে আসা হল, তা হলেও উত্তরটি খুব পাল্টাবে না। কথাটি যে মিথ্যা, তা নয়। সরকারের সত্যিই রাজস্ব প্রয়োজন। কিন্তু, সেই রাজস্ব আদায়ের জন্য বারে বারে বাবুরাম সাপুড়ের সাপটিকেই ঠান্ডা করে দিতে হয় কেন, এই প্রশ্নটি করা দরকার। সরকার যাঁদের উপর এই করের বোঝা চাপাচ্ছে, তাঁদের পক্ষে কি সত্যিই এই বোঝা সহনীয়?
এই অতিমারি এবং প্রবল মূল্যবৃদ্ধির আবহে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটি আরও জোর গলায় তোলা প্রয়োজন। গত সওয়া দুই বছরে বহু লোক কাজ হারিয়েছেন, তারও বেশি মানুষের আয় কমেছে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে। অর্থাৎ, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এই অবস্থায় পেট্রোপণ্যের উপর বিপুল হারে কর আদায়ই হোক, অথবা নতুনতর নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং মূলত গরিব-ভোগ্য পণ্যকে জিএসটির আওতায় নিয়ে আসা বা তার উপর করের পরিমাণ বৃদ্ধিই হোক, তার নিট ফল একটিই— এই সিদ্ধান্ত দু’টিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করবে। পাইকারি মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যস্ফীতির হার যখন পনেরো শতাংশেরও ঊর্ধ্বে, এবং ডলারের সাপেক্ষে টাকার মূল্য হ্রাস ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য যখন অধিকতর মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা তৈরি করছে, তখনই কি জিএসটি বৃদ্ধির প্রকৃষ্ট সময়? বরং, এই সময়েই কি পেট্রল-ডিজ়েলের উপর শুল্কের পরিমাণ কমিয়ে সাধারণ মানুষকে খানিক রেহাই দেওয়া যেত না?
একটি কথা স্পষ্ট ভাবে বলা প্রয়োজন যে, কেন্দ্রীয় সরকার কর আদায়ের ক্ষেত্রে মূলত ব্যর্থ। সেই ব্যর্থতা ঢাকার প্রকৃষ্টতম পন্থা দাঁড়িয়েছে পেট্রোপণ্যের উপর যথেচ্ছ কর আদায় করা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম গত কয়েক মাসে চড়েছে, কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে যখন সেই দাম তলানিতে ছিল, তখনও দেশের বাজারে তেলের দাম কমেনি, কারণ সেই সুযোগে সরকার প্রভূত রাজস্ব আদায় করে অন্য খাতের রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি পূরণ করছিল। জিএসটির মতো পরোক্ষ করের ক্ষেত্রেও সরকারের সুবিধা হল, কারও পক্ষেই এই কর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সহজ শিকার, ফলে এই নিশানাতেই কেন্দ্রীয় সরকার গুলি চালাতে অভ্যস্ত। তাতে ধরাশায়ী হচ্ছেন দেশের সাধারণ মানুষ, যাঁরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন শরে আহত— নোট বাতিল থেকে লকডাউন, তাঁদের দেহে ক্ষতচিহ্ন অনেক। নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর মূল্যবৃদ্ধি এখন দেশব্যাপী সঙ্কট তৈরি করেছে। এই অবস্থায় জিএসটির হার বাড়ানো, অথবা তেলের উপর প্রভূত কর আদায় করার নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ।