প্রতীকী ছবি।
এক বৎসরে এক কোটি গ্রামীণ গৃহ পানীয় জলের পাইপের সহিত যুক্ত হইবে, ঘোষণা করিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কাজটি জরুরি। পানীয় জল আনিতে ভারতের গ্রামে মেয়েরা বৎসরে যত পথ অতিক্রম করেন, তাহার দৈর্ঘ্য একত্র করিলে পৃথিবী হইতে চাঁদ ঘুরিয়া আসা যায়। মেয়েদের শ্রমের প্রতি এই অবহেলা সারা ভারতেই দেখা গিয়াছে, তবে পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে অভিযোগ কিছু অধিক। কেন্দ্রের দাবি, ২০১৯ সালে সূচিত ‘জলজীবন মিশন’-এর রূপায়ণে পশ্চিমবঙ্গ সকল রাজ্যের শেষে। বাংলার ১.৬৩ কোটি গ্রামীণ গৃহের মাত্র দুই লক্ষ ঘরের মধ্যে জলের কল রহিয়াছে। প্রধানত দলিত, আদিবাসী, অতি-দরিদ্র পরিবারগুলি বাদ পড়িয়াছে পাইপবাহিত পানীয় জলের ব্যবস্থা হইতে। ২০১৯-২০ সালে কেন্দ্র প্রায় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়াছিল এই প্রকল্পে, রাজ্য তাহার অর্ধেকও খরচ করিতে পারে নাই। আর্সেনিক এবং ফ্লোরাইড-আক্রান্ত অঞ্চলে নিরাপদ জল সরবরাহের জন্য কেন্দ্রের পৃথক বরাদ্দেরও অধিকাংশ পড়িয়া আছে। অর্থের অভাব নাই, অভাব উদ্যোগের। গ্রামীণ এলাকায় পানীয় জল সরবরাহে ত্রুটির বিষয়টিকে তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতা বলিয়া নির্বাচনী প্রচার করিয়াছিল বিজেপি। সেই কারণেই কি রাজ্য সরকার তিন বৎসরের বকেয়া কাজ এক বৎসরে সারিবার পণ করিতেছে?
তবে, বিলম্বের দায় সম্পূর্ণত রাজ্য সরকারের উপর চাপানো মুশকিল। জলকর আদায়ের নীতির বরাবরই বিরোধিতা করিয়াছে তৃণমূল সরকার। জলজীবন মিশনের অন্যতম শর্ত ছিল, প্রকল্পের জন্য ব্যয়ের দশ শতাংশ উপভোক্তাদের বহন করিতে হইবে, কেন্দ্র পঞ্চাশ শতাংশ এবং রাজ্য চল্লিশ শতাংশ বহন করিবে। রাজ্য সরকার ২০১৯ সালেই প্রস্তাব দিয়াছিল, উপভোক্তার অংশ-সহ পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার রাজ্যই বহন করিতে চাহে। কেন্দ্র তাহা অনুমোদন করিতে নয় মাস কাটাইয়া দিয়াছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গ পিছাইয়া পড়িয়াছে। যে কোনও সরকারি প্রকল্পের ব্যর্থতার ব্যাখ্যায় কেন্দ্র ও রাজ্যের এমন চাপানউতোর শুনিতে নাগরিক অভ্যস্ত। যদিও জলকর বসাইবার ঔচিত্য লইয়া বিতর্কটি তুচ্ছ নহে। কর বসাইবার পক্ষে যুক্তি রহিয়াছে— জলকর আদায় করিলে সরকারি প্রকল্পের অংশীদার হইয়া উঠে নাগরিক, তাহাতে জল নষ্টের প্রবণতা কমিতে পারে। কিন্তু, সংবিধান অনুসারে জল সরবরাহ রাজ্যের বিষয়, সেখানে কেন্দ্রের খবরদারির পরিসর কতটুকু? পানীয় জল পরিষেবার মতো বিষয়েও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রধান হইয়া উঠিলে তাহা উদ্বেগের বিষয়।
সম্মুখে কঠিন কর্তব্য। অধিকাংশ গ্রামীণ গৃহস্থালিতে পাইপ-সংযুক্ত করিলেই হইবে না, যথেষ্ট পরিমাণে নিরাপদ জলের ব্যবস্থা করিতে হইবে। বর্তমানে যে সকল ব্লকে ভূগর্ভের জল আর্সেনিক অথবা ফ্লোরাইডে দূষিত, সেখানেও অধিকাংশ মানুষ টিউবওয়েল ব্যবহার করেন। ভূগর্ভের জলস্তর নামিতেছে। পরিবেশ রক্ষা করিয়া প্রতিটি গৃহে পর্যাপ্ত দূষণমুক্ত জল পাঠানো যাইবে কী রূপে, সেই প্রশ্নটি যথেষ্ট সময় এবং আলোচনা দাবি করে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি এবং গ্রামবাসীর, বিশেষত মহিলাদের মতামত জানিবার প্রয়োজন কম নহে। সেই পর্ব কি সম্পূর্ণ হইয়াছে? পানীয় জল পরিষেবাও কেবল সরকারি সাফল্যের পরিসংখ্যানে পর্যবসিত হইবে কি না, সেই আশঙ্কা রহিয়াই গেল।