বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে...’ তার পরের কথা সকলেরই জানা। পদে পদে মাঝিকে প্রশ্নে প্রশ্নে নির্বোধ প্রমাণ করার পর বাবুমশাই নিজে শেষ কালে প্রায় ডুবে মরেন। বেশির ভাগ মানুষের সমর্থন যায় মাঝির দিকে, কারণ তাঁর জ্ঞানটা কাজে লাগে আর অহঙ্কারী বাবুমশাই-এর ওই ‘কেন’ ‘কী করে’ জাতীয় জ্ঞানবুদ্ধি বাস্তবে কোনও কাজে লাগতে দেখা যায় না। কিন্তু সব যুগেই কিছু মানুষ ওই বাবুমশাইয়ের (অহঙ্কারটুকু বাদে) পক্ষেও থাকেন, তা না হলে আর বিজ্ঞানের পড়াশোনা হতই না। ওই ‘কেন’ আর ‘কী করে’ প্রশ্নই হল বিজ্ঞানের গোড়ার কথা। আর মাঝি যে এ সব না জেনেও ঢেউকে সামলাতে পারেন, তার পিছনেও আছে বিজ্ঞানের নিয়মের সঠিক ব্যবহার। ঠিক যেমন আপনি লীন তাপের তত্ত্ব না জেনেও গরমকালে মাটির কলসিতে জল রাখেন, ফ্যানের হাওয়া খান, চাপের সঙ্গে স্ফুটনাঙ্কের সম্পর্ক না জেনেও ভাতের হাঁড়িতে ঢাকনা দেন, সে রকমই।
২৮ ফেব্রুয়ারি ছিল জাতীয় বিজ্ঞান দিবস। এখনও এই দিনে যাঁর কথা ভেবে আমরা গর্বে ফুলে উঠি, সেই সি ভি রামনের (ছবিতে) জন্মদিন নয়, মৃত্যুদিন নয়, এমনকি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দিনও নয়, বরং বিখ্যাত ‘রামন এফেক্ট’ আবিষ্কার করার দিন। এই দিনটাকে বিজ্ঞান দিবস হিসেবে পালন করার কথা যাঁর মাথায় এসেছিল, তাঁকে অনেক ধন্যবাদ, বিজ্ঞানী যে তাঁর কাজের জন্যই মনে থাকেন, সেই কথাটি এই দিনের মধ্যে দিয়ে স্মরণ করানোর জন্য।
প্রতি বছর বিজ্ঞান দিবসের একটা ‘থিম’ থাকে। এই বছরের থিম ‘বিজ্ঞানে নারী’। কথাটা জেনে নারী হিসেবে আমার খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু বিষয়টা যেন কিঞ্চিৎ গোলমেলে ঠেকল। এই থিম অনুসারে বিজ্ঞান বলতে সম্ভবত পেশাগত বিজ্ঞানে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে যে চিন্তাভাবনা হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞান দিবস পালনের মুখ্য উদ্দেশ্য হল সার্বিক ভাবে বিজ্ঞানচেতনার উন্নতি, তার জন্য ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিজ্ঞানী কিছুই হওয়ার দরকার নেই, শুধু একটু যুক্তিবাদী হতে হবে। বিজ্ঞান হল ব্যক্তিনিরপেক্ষ এক সত্য যা নানা নিয়মকানুনের মধ্যে দিয়ে আপনিই প্রকাশিত হয়; মানুষ তাকে আবিষ্কার করতে পারে, ব্যবহারও করতে পারে, কিন্তু সৃষ্টি বা ধ্বংস করতে পারে না। তাই বিজ্ঞান অভিশাপ বা আশীর্বাদ কিছুই হতে পারে না। জানা-না-জানা, বিশ্বাস করা-না-করার ওপর তার অস্তিত্ব নির্ভর করে না। মৌমাছির চাকের ছ’কোনা খোপে, সূর্যমুখীর বীজের প্যাঁচানো বিন্যাসে, আপনার চেতনার রঙে সবুজ বা লাল হয়ে ওঠা পান্না-চুনির দ্যুতিতে সর্বদাই আছে কিছু কেন’র উত্তর; সেই উত্তরের নামই বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানের অস্তিত্বকে মনে করানোর দিন হল বিজ্ঞান দিবস, যাতে বছরের বাকি দিনেও আমরা বিজ্ঞানকে সঙ্গে নিয়েই চলি।
এক-একটা মিথ্যে বার বার উচ্চারণ করতে করতে সত্যি হয়ে ওঠে। আইনস্টাইনের কথা থেকে কিছু অংশ তুলে নিয়ে অনেকেই বলেন যে উনি নাকি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন! তা করতেই পারেন, তবে কথাটা বিশ্বাস করার আগে একটু দেখে নেওয়া ভাল ভদ্রলোক নিজে কী বলেছেন। “আমি সেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করি যিনি যাবতীয় সুচারু ছন্দ ও নিয়মের মধ্যে প্রকাশিত হন— যিনি মানুষের ভাগ্য ও কর্ম নিয়ন্ত্রণ করেন সেই ঈশ্বরে নয়।” অতএব, বিশ্বাস নয়, সেই নিয়মের কাছেই পৌঁছনো। তাই ভূত-ভগবান-তাবিজ-কবচ-গ্রহরত্ন যা-ই বিশ্বাস করুন— কী করে তা কাজ করে, জেনে নিয়ে করুন।
আবার কিছু সত্যি কথাকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েও সত্যি করে তোলা যায় না। যেমন ভারতীয় সংবিধানের ‘ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট (১৯৫৪)’ অনুসারে ওই তাবিজ-কবচ আরও যা যা বললাম, সেগুলো সব অন্যায়। কিন্তু কোথায় সেই বিজ্ঞানচেতনা! এই সে দিনও পড়লাম সাপে কামড়ানোর পর দু’টি শিশুকে হাসপাতালের বদলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওঝার কাছে, পরিণাম মৃত্যু। এই কিছু দিন আগে দেখলাম এক দল শিক্ষিত তরুণ-তরুণী রীতিমতো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভূত ধরতে বেরিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা যা দেখালেন তা হল ভূত একটি কঠিন তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ (অর্থাৎ সোনার পাথরবাটি), যা কোনও ভাবে মাধ্যমকে উষ্ণ করে তোলে। এই দু’টি ক্ষেত্রেই যাঁরা কাজটা করছেন আর যাঁরা সমর্থন করছেন কারও মনে কোনও প্রশ্ন আসেনি যে ‘কী করে হবে’! এমন যুক্তিহীন বিশ্বাসেই লোকে গোরুর দুধে সোনা, ময়ূরের অশ্রুতে গর্ভধারণ, গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি, রামলালার জন্মভূমি, ভারতের মুসলিম রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া ইত্যাদি যাবতীয় কষ্টকল্পনাকেই সত্যি বলে মনে করে। তাই বিজ্ঞানমনস্ক হতে গেলে আসলে যে কোনও ঘটনা কেন ঘটছে, কী ভাবে ঘটছে, জানতে চাইতে হবে।
এই ভাবে যিনি আমাদের বিজ্ঞানচেতনার পাঠ দিয়েছেন, এই বছর তাঁর দু’শো বছর পূর্ণ হল। অক্ষয়কুমার দত্তের লেখা ‘চারুপাঠ’ বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রথম মাইলফলক। তাঁকে আমরা মনে রাখিনি, না হলে এই বছর তাঁর বিজ্ঞানভাবনা নিয়ে কিছু আলোচনা হতে দেখা যেত। তাঁর নির্দেশিত পথে চললে আমাদের বিজ্ঞানচেতনা এত দিনে কিছু সাবালক হয়ে উঠতে পারত।