১৯৩৪। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ঐক্য গড়ে তুলতে স্তালিনের সঙ্গে বৈঠক করেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নেতা জর্জি দিমিত্রভ। স্তালিন মনে করতেন, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা হল ‘সোশ্যাল ফ্যাসিস্ট’, সুতরাং তাদের পর্যুদস্ত না করে ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। দিমিত্রভ বললেন, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির গর্ভ থেকে ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান ঘটলেও, সারা বিশ্বেই এমন বহু ছোট বড় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শক্তি, এমনকি কিছু বুর্জোয়া লিবারাল দলও আছে, যারা ফ্যাসিস্টদের হাতে অত্যাচারিত। তাদের প্রতিবাদী ভূমিকাও রয়েছে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী একতার জন্য যুক্তমোর্চা আবশ্যক। স্তালিন সে কথা মেনে নেন।
এ প্রসঙ্গের অবতারণার কারণ, ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপি-বিরোধী তথা ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ঐক্য নির্মাণে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে নিয়ে জোটের যে প্রত্যাশা মার্ক্সবাদী দলগুলির কাছে ছিল, সেখানে ছুতমার্গ দেখা যাচ্ছে। বিহার নির্বাচন নিয়েও বামপন্থীদের কিঞ্চিৎ উল্লাস চিন্তার দীনতাই প্রকাশ করে। এসইউসিআই(সি) কেন একা লড়ল? শেষ পর্যন্ত লাভ হচ্ছে বিজেপিরই। সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগি না হলে তাদের জয়ের পথ সুগম হত না। মনে রাখতে হবে, বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেই অবস্থান দৃঢ় করতে চায় ফ্যাসিবাদ। তাই নির্বাচনী লড়াইকেও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের অংশ হিসেবে মান্যতা দেওয়া দরকার। দুঃখের কথা, বামপন্থী ও মার্ক্সবাদী দলগুলির আচরণ সুচিন্তিত ঐক্যের লক্ষ্যে নয়, বরং সুবিধাবাদী। গোটা দেশে কংগ্রেস-সহ সমস্ত বিজেপি বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে জোট গড়ার কথা বলছে সিপিএম, অথচ পশ্চিমবঙ্গে লড়াইয়ের মূল বর্শামুখ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। আবার, যে এসইউসিআই(সি) তৃণমূলের জোটসঙ্গী ছিল, কংগ্রেস উপস্থিত থাকলে তারা বামদলগুলির কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে না!
ফ্যাসিবাদকে রুখতে হলে বামপন্থীদের দুটো বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। এক, নিছক নির্বাচনী ঐক্য নয়, প্রয়োজন আদর্শের ঐক্য। বহুমাত্রিক চিন্তার মধ্যে যে বিষয়গুলো নিয়ে সহমত হওয়া যাচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করে তার ভিত্তিতে ঐক্য তৈরি করতে হবে। দুই, মার্ক্সবাদ একটি চলমান ও সতত বিকাশশীল আর্থ-সামাজিক বিশ্ববীক্ষা— এ কথা বুঝতে হবে। এই বিশ্ববীক্ষার এক একটি পরিমণ্ডলের সত্য ধারণা যেমন বাস্তব, আবার তা অতিক্রান্ত হলে নতুন সত্যকেও খুঁজতে হয়। আর্থ-সামাজিক কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখেও নানা পরিবর্তন ঘটে। মার্ক্সবাদীদের কাছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূল সমস্যা একই থাকলেও গত ২০০ বছরে পুঁজিবাদের প্রচুর বদল ঘটেছে। লেনিনের মতো নেতারা পরিবর্তিত চেহারাগুলো বুঝে মার্ক্সবাদকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করেছেন। সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদের বিশেষ আগ্রাসী রূপকে চিহ্নিত করেছিলেন লেনিন।
সাম্রাজ্যবাদও আবার সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে নেই। তার পথ বেয়ে ফ্যাসিবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। ফ্যাসিবাদের উন্মেষ দেখে সাবধানবাণী দিয়েছিলেন লেনিন, কিন্তু ইটালির কমিউনিস্টরা বুঝতে পারেননি। বস্তুত, দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের দলগুলো শোধনবাদী, জাত্যভিমানী এবং বিপ্লব-বিরোধী হয়ে যাওয়ার ফলে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের চিন্তাসূত্র ধরেই ফ্যাসিবাদের প্রকাশ ঘটে। সে জন্যই স্তালিনকে তাদের বিরোধিতা করতে হয়েছিল।
১৯২৭ সালে তৃতীয় ইন্টারন্যাশনালের নেতা নিকোলাই বুখারিন যে প্রস্তাব আনেন, তাতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসিকে ‘সোশ্যাল ফ্যাসিস্ট’ বলে উল্লেখ করা হয়। নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে এই তত্ত্বের কার্যকারিতা যেমন অপ্রমাণ করা যায় না, তেমনই এর দায়িত্ব এক ব্যক্তির ঘাড়ে চাপানোও অনুচিত। এ কারণেই মার্ক্সবাদ চলমান বিশ্ববীক্ষা। লেনিনের পরবর্তী প্রায় সব মার্ক্সবাদীরই চলমানতার উপলব্ধিতে ঘাটতি থেকে গিয়েছে, স্তালিনের মতো কেউ ভুল শুধরেও নিয়েছেন।
এখানকার বামদলগুলি মূলত দু’ধরনের চিন্তায় বিভক্ত। এক, মার্ক্সবাদীরা দক্ষিণপন্থী বা বুর্জোয়া লিবারাল দলের সঙ্গে ঐক্যে যেতে পারে না। দুই, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শক্তির সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলা যায় না, বড়জোর বিষয়ভিত্তিক যৌথ কর্মসূচি চলতে পারে। সিপিএম-এর মতো সর্ববৃহৎ মার্ক্সবাদী দল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই কর্মসূচির বদলে নির্বাচনী সমঝোতাতে বেশি আগ্রহী। প্রধান লক্ষ্য, পশ্চিমবঙ্গ পুনর্দখল করা। তাই তারা যতটা না বিজেপি-বিরোধী, তার চেয়েও বেশি তৃণমূল-বিরোধী। সে জন্য কংগ্রেস-সহ অন্য দক্ষিণপন্থী শক্তির সঙ্গে জোটেও তাদের আপত্তি নেই। এরাই এক কালে ইন্দিরা গাঁধীর স্বৈরাচারী সরকারের বিরোধিতার জন্য জনসঙ্ঘের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।
সে-দিনকার সমঝোতা হয়তো তখনকার প্রেক্ষিতে যুক্তিসঙ্গত ছিল। আজকের পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটও প্রয়োজনীয় হতে পারে। কিন্তু তা মানলে তো তৃণমূলকে প্রধান শত্রু চিহ্নিত করার যুক্তি ধোপে টেকে না! এসইউসিআই(সি) নাকি ভোটে জেতার জন্য লড়ে না, আন্দোলনই মূল উদ্দেশ্য। লেনিনবাদের সেই বুনিয়াদি শিক্ষা কী করে তারা বিস্মৃত হল যে, যত ক্ষণ না বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারা যাচ্ছে, তত ক্ষণ গুরুত্ব দিয়েই নির্বাচনে লড়তে হবে? দিমিত্রভের পর্যবেক্ষণ ছিল, ফ্যাসিবাদের ক্ষমতায় আরোহণ এক বুর্জোয়া সরকারের বদলে আর একটির স্থান অধিকারের মতো সাধারণ ঘটনা নয়। এ হল বুর্জোয়া শ্রেণির নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার এক ধরনের রাষ্ট্ররূপ— প্রকাশ্য ‘সন্ত্রাসবাদী’ একনায়কত্ব স্থাপন। এই পার্থক্য উপেক্ষা করা মানে আত্মঘাতী হওয়া।
সুতরাং, আজকের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাম-দক্ষিণ নির্বিশেষে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে, সব ধরনের সংগঠনকে শামিল করে সর্বাত্মক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া, কর্মসূচির ভিত্তিতে সমস্ত মার্ক্সবাদী দলের ঐক্যসাধনও প্রয়োজন। তার ভিত্তিতেই কংগ্রেস, তৃণমূল, আরজেডি, এসপি, বিএসপি— সবাই এক মঞ্চে আসতে পারে। না হলে ফ্যাসিবাদের পতন অসম্ভব।