Violence

দিল্লির ঘটনা দেখিয়ে দিল, সভ্যতার অগ্রগমনের মধ্যে হিংসা লুকিয়ে থাকে

কে না জানে, যুগে যুগে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার অস্ত্র তাকে যৌন হেনস্থা করা, শারীরিক অত্যাচার করা, ধর্ষণ করা!

Advertisement

রত্নাবলী রায়

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২২ ১২:৫৮
Share:

গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে মিশে রয়েছে সার্বভৌমত্বের ধারণা। সার্বভৌমত্ব কি শুধু রাষ্ট্রের হয়? মানবশরীরের কি সার্বভৌমত্ব নেই? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ঘণ্টাকয়েক হল শেষ হয়েছে সাধারণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ। রাজধানী দিল্লিতে উৎসবের মেজাজ তখনও পুরোদমে। হাজার হোক, তথাকথিত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ৭২ বছরে পা রাখল বলে কথা!
‘তথাকথিত’ শব্দটা দেখে কি চোখ কুঁচকে যাচ্ছে আপনার? মনে হচ্ছে কেন এই শব্দের প্রয়োগ? কারণ, যে মুহূর্তে ভারতীয়দের একটা বড় অংশ গণতন্ত্রের উৎসবে বুঁদ, সেই একই সময়ে পূর্বদিল্লির কস্তুরবা নগরে একটি বাইশ বছরের তরুণীকে গণধর্ষণ করার পরে মাথা মুড়িয়ে মুখে কালি মাখিয়ে ঘোরানো হচ্ছে। কেন? মহিলা কমিশনের বিবৃতি থেকে জানা যাচ্ছে, মেয়েটির প্রেমিক আত্মহত্যায় মারা যাওয়ার জন্য মেয়েটিকেই দায়ী করেছিল যুবকটির পরিবার এবং তাদের মদতেই মেয়েটিকে গণধর্ষণ করা হয়। মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী হয়ে এটা জানি যে, আত্মহত্যার কারণ নির্ধারণ করা সহজ বিষয় নয়। কী কারণে তিনি আত্মহত্যায় মারা গেলেন তার উত্তর ওই ব্যক্তিটির সাথে বিলীন হয়ে গেল, সেখানে এই মেয়েটির দোষ কোথায়?

Advertisement

যদিও এ ঘটনার পর দিল্লি পুলিশের তৎপরতায় ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তবু সাধারণতন্ত্রের দিনে এমন ঘটনা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে অনেকগুলো। এমন নয় যে, অন্য কোনওদিনে ঘটলে প্রশ্নগুলো এড়ানো যেত। কিন্তু একদিকে গণতন্ত্রের উল্লাস, অন্যদিকে সেই জনতারই সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ জন্ম দিয়েছে এক বিকট বৈসাদৃশ্যের, যা স্বতন্ত্রভাবেই উল্লেখের দাবি রাখে।

গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে মিশে রয়েছে সার্বভৌমত্বের ধারণা। সার্বভৌমত্ব কি শুধু রাষ্ট্রের হয়? মানবশরীরের কি সার্বভৌমত্ব নেই? এমনিতেই পত্রপত্রিকার বিভিন্ন রাজনৈতিক লেখায় বারেবারেই রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও শরীরের সার্বভৌমত্বকে এক করে দেওয়া হয়। এবং তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় যৌনগন্ধী। অস্ত্রের সঙ্গে তুলনীয় হয় পুরুষের লিঙ্গ, যা দিয়ে অসূর্যম্পশ্যা ভূমি দখল করা চলে। নেহাত মজার ছলেই ছুড়ে দেওয়া হয় নানা রাজনৈতিক-সামরিক শব্দবন্ধ, যার আগাপাশতলায় মিশে রয়েছে যৌনতার গন্ধ; অন্যভাবে বললে নারীকে দখল করার গল্প। ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’ বলতে কি ঠিক সেটাই বোঝায় না?

Advertisement

এমন এক পরিস্থিতিতে পূর্বদিল্লির ঘটনা তাই আরও অনেক অস্বস্তির জন্ম দিয়ে যায়। এর আগেও এই দিল্লিতেই ঘটে গিয়েছিল নির্ভয়ার ঘটনা। সেবার ছিল শুধু নারীশরীরের ওপর পুরুষের দখলদারিত্বের প্রকাশ। সোজাসাপ্টা ধর্ষণ, আর অত্যাচার। আর এবার সেই পুরুষতান্ত্রিকতার সঙ্গে মিশে গিয়েছে আরও অনেকগুলো স্তর। মাথায় রাখতে হবে, মেয়েটির ওপরে অত্যাচারের ঘটনায় যাঁরা গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ন’জনই মহিলা।

প্রতীকী ছবি।

অভিযোগ, মেয়েটিকে যখন ধর্ষণ করা হচ্ছিল, এঁরা পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিচ্ছিলেন, ধর্ষণের পরে মাথা মুড়িয়ে মুখে কালি ঢেলে ঘোরানোর সময়ও এই মহিলাদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো! খুব সঙ্গত অভিযোগেই গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁদের, যা উসকে দিয়েছে আরও একটি প্রচলিত ন্যারেটিভ, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু।

আপাতদৃষ্টিতে কথাটা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হলেও আসলে তা নয়। পুরুষতান্ত্রিকতা এমনই একটা বিষয় যা স্মরণাতীতকাল থেকে শেকড় ছড়ায় মনের গভীরে, কখনও কখনও তাকে আলাদা করে পুরুষতান্ত্রিকতা বলে চেনাও যায় না। সাদাকালোর মাঝে মিশে থাকে অনেকটা ধূসর জায়গা আর সেখানেই ডালপালা ছড়ায় পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব। নানা রূপে, নানান আকারে নিজেকে প্রকাশিত করে সে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার পিতৃতান্ত্রিকতার তেমনই একটি বহিঃপ্রকাশ। দুর্বল অর্থে শারীরিক ভাবে দুর্বল, লোকবলের দিক থেকে দুর্বল, সামাজিক বা শ্রেণীগত অবস্থানের দিক থেকেও দুর্বল। যে কোনও বড় ভায়োলেন্সের ঘটনার সঙ্গে একটা শ্রেণিগত বা জাতিগত অবস্থান জুড়ে থাকে, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দলগতভাবে ওই মহিলারা একজোট হয়েই হামলায় ইন্ধন জুগিয়েছেন। আর হাতেনাতে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার কাজটি সম্পাদন করেছেন পুরুষেরা।

এখান থেকেই আরও একটা দৃষ্টিকোণ পেয়ে যাচ্ছি আমরা। পুরুষতান্ত্রিকতা, দুর্বলের ওপর সবলের জোর ফলানো আর শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে— এই তিনটেই মিশে গিয়েছে দিল্লির সাধারণতন্ত্র দিবসের ঘটনায়। শুধু মেয়েটিকে শিক্ষা দেওয়াই নয়, একইসঙ্গে তার পরিবারকে শিক্ষা দেওয়া, তার শ্রেণীকে শিক্ষা দেওয়া, সে যে-যে বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করে, তার সবকিছুকে শিক্ষা দেওয়া। সব্বাইকে জানিয়ে দেওয়া, আমাদের মতের বিরুদ্ধে যে গিয়েছে তার অবস্থা এমন হয়েছে। অতএব সমঝে যাও, আমাদের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কোরো না।

প্রতীকী ছবি।

এর আগে ‘সুল্লি ডিল্স’ বা ‘বুল্লি বাই অ্যাপে’ কি একই মানসিকতার প্রতিফলন দেখিনি আমরা? সেখানে অবশ্য ধর্মীয় একটা দিকও মিশে ছিল। সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, প্রতিষ্ঠিত, সচেতন মুসলমান মেয়েদের ছবি দিয়ে তাঁদের ভার্চুয়াল নিলামে তোলা হয়েছিল। মহিলাদের প্রতি অত্যাচারের শ্রেণিগত ও জাতিগত অবস্থানের পাশাপাশি তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়টাকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে একটা শিক্ষা দেওয়ারই চেষ্টা ছিল ওই কার্যকলাপে।

আর কে না জানে, যুগে যুগে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার অস্ত্র তাকে যৌন হেনস্থা করা, শারীরিক অত্যাচার করা, ধর্ষণ করা? সেজন্যই ‘জেন্ডার ভায়োলেন্স’-এর প্রসঙ্গে, বাড়ির বউদের মারধর করার বিরোধিতা করা হলে সরল বিস্ময়ে চোখ কপালে তোলেন বহু শিক্ষিত শ্রেণির মানুষেরাও, যেন বাড়ির বউদের গায়ে হাত তোলাটাই জীবনের সবচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা! সেই কারণেই ভারতীয় আদালত বৈবাহিক ধর্ষণকে ‘অপরাধ’ ঘোষণা করলে প্রতিবাদের ঢেউয়ে সামিল হন আমার-আপনার শ্রেণির হাজারো পুরুষ! যুগযুগ ধরে উপভোগ করা অধিকার কি অত সহজে ছেড়ে দেওয়া যায়! আশ্চর্যের বিষয়, এই ধারণা থেকে মুক্ত নন মেয়েরাও, কারণ ছোট থেকে তাঁদের সেভাবেই শেখানো হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিকতার শিকড় এমনভাবে তাঁদের মাথায় প্রোথিত করে দেওয়া হয়েছে যে তাঁরা আর আলাদা করে বিষয়টা অনুধাবন করার সুযোগই পাননি। কারণ, সে ধারণাটাই তাঁদের নেই! সেই রাতে ধর্ষক অত্যাচারী পুরুষদের যে মেয়েরা মদত দিচ্ছিলেন, হয়তো তাঁরা এই গোত্রেরই ফসল।

সাধারণতন্ত্র দিবসের রাতে দিল্লির মেয়েটির ওপরে যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার স্তরে-স্তরে মিশে রয়েছে এরকম নানা মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। সভ্যতা যতই এগোক, প্রযুক্তি যতই উন্নততর হোক, সমাজে মেয়েদের অবস্থান কতটা পরিবর্তন হয়েছে, তা নিয়ে তর্ক আছে | আসলে সভ্যতা এবং তার অগ্রগমনের মধ্যে হিংসা লুকিয়ে থাকে। এবং সেই কারণেই নারী আন্দোলন চিরকালই প্রাসঙ্গিক। কারণ, শুধু সচেতন নয়, আমাদের সজাগ থাকতে হবে বরাবর।

ভাইরাস যেমন নানা রূপে, নানা আকারে নিজেকে ‘মিউটেট’ করে, তেমনই নানা ফর্মে নিজেকে প্রকাশ করছে ‘জেন্ডার বেস্ড ভায়োলেন্স’| সভ্যতা কখনও কোনও পরিস্থিতিতেই মেয়েদের ওপর নির্যাতন কমাবে না। সে জন্যই সজাগ থাকতে হবে মেয়েদের| ‘দশপ্রহরণধারিণী’ হয়ে নারীদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই!

(লেখক মনো-সমাজকর্মী। মতামত নিজস্ব)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement