কলতান

মনে রাখা প্রয়োজন, পাখিরা বাসা বাঁধিতে ভুলিয়াছে বলিয়া শহর ছাড়ে নাই। শহর হইতে তাহাদের মুখ ফিরাইবার কারণ, দূষণের প্রকোপ এবং ইট-কাঠ-কংক্রিটের জঙ্গলে নিরাপদ আশ্রয়গুলি হারাইয়া ফেলা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share:

কলতান কমিতেছে। পূর্বের ন্যায় শহরের বুকে ভোর হইবার সরব ঘোষণাটি পাখিদের কণ্ঠে আগের মতো আর শোনা যায় কই! তাহার জায়গা লইয়াছে ঘড়ির যান্ত্রিক স্বর অথবা হর্নের শব্দ। শহুরে পার্কেও পাখিদের আনাগোনা কমিয়াছে। চোখে পড়ে না গাছের ডালে তাহাদের বাসা বাঁধিবার, গৃহস্থালি সাজাইয়া সন্তানপালনের মনোরম দৃশ্যগুলি। দুরবস্থা এমনই, বন দফতরকে উদ্যোগ করিতে হইয়াছে তাহাদের ফিরাইয়া আনিবার। পশ্চিম মেদিনীপুরের চারটি বিনোদন পার্কে পাখিদের জন্য হাঁড়ি বসাইয়া বাসা বাঁধিয়া দিতেছে বন দফতর। শুধু তাহাই নহে, মানুষের তৈরি বাসায় পাখিদের আনাগোনা ও তাহাদের জীবনচক্রের প্রতি পর্যায়ে নজরদারির পরিকল্পনাও হইয়াছে। প্রকল্পের নামটিও সুন্দর— কিচিরমিচির।

Advertisement

নাম শ্রুতিমধুর হইলেও বাস্তবে সেই কিচিরমিচির আদৌ ফিরিবে কি না, সন্দেহ। মনে রাখা প্রয়োজন, পাখিরা বাসা বাঁধিতে ভুলিয়াছে বলিয়া শহর ছাড়ে নাই। শহর হইতে তাহাদের মুখ ফিরাইবার কারণ, দূষণের প্রকোপ এবং ইট-কাঠ-কংক্রিটের জঙ্গলে নিরাপদ আশ্রয়গুলি হারাইয়া ফেলা। পাখিদের সন্তানপালনের মতো উপযুক্ত পত্রশোভিত বৃক্ষই বা শহরে কয়টি আছে? যাহা আছে, তাহাতে শৌখিনতার পরিচয় মেলে, কিন্তু পাখপাখালির আশ্রয়স্থল হইয়া উঠিতে পারে না। তাল-নারকেল গাছের আশ্রয় হারাইয়া বাবুইপাখিকেও বাসা বাঁধিতে হয় বিদ্যুতের তারে। অকালমৃত্যু ঠেকাতে সেই বাসা ভাঙা হইয়াছে বটে, কিন্তু বাবুই যাইবে কোথায়? আর অন্য পাখিরা? উত্তর কেহ জানে না। আশ্চর্য হইতে হয়, কী দ্রুততায়, প্রায় সবার অলক্ষ্যে, মানুষের এই পড়শিটি বিদায় লইতে বসিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গে বসিয়া মেরুপ্রদেশের বরফ গলিবার খবরে উদ্বিগ্ন হওয়া ভাল, বাঘ-সিংহের সংখ্যা কমিয়াছে বলিয়া দুঃখপ্রকাশ করাও ভাল। কিন্তু গার্হস্থ-জীবনের সঙ্গে এক কালে ওতপ্রোত ভাবে জড়াইয়া থাকা চড়াই-শালিক-পায়রাদের আর দেখা পাওয়া যায় না কেন— সেই কারণগুলি লইয়া বিশদ আলোচনা আরও ভাল। আরও দরকারি।

আশঙ্কাজনক হইয়া উঠিতেছে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়াই পরিবেশ রক্ষার স্লোগানও। ইহাতে হুজুগই সার, কাজের কাজ কম। ‘কিচিরমিচির’ প্রকল্পটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। কিন্তু পরিবেশ বাঁচাইতে হইলে বিচ্ছিন্ন ভাবে লওয়া কিছু উদ্যোগ ফলপ্রসূ হইবে না। তাহার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে একটি সার্বিক পরিকল্পনার প্রয়োজন। সরকারকেই সেই উদ্যোগ করিতে হইবে। শহরে চড়াই-সহ বেশ কিছু পাখির অবলুপ্তির কারণ হিসাবে মোবাইল টাওয়ারের তীব্র চৌম্বক বিকিরণকে দায়ী করা হইয়াছে। সেই বিকিরণ হ্রাস করিতে সরকার উদ্যোগী না হইলে তাহারা ফিরিবে কী উপায়ে? শহরে ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদনের ফলে তাহারা আশ্রয় হারাইয়াছে। সেই আশ্রয় তাহাদের ফিরাইয়া দিতে হইলে শুধুমাত্র ‘গাছ লাগাও’ স্লোগানেই কর্তব্য শেষ হয় না। মাটির চরিত্র বিশ্লেষণ করিয়া কোন গাছ শহরের কোন জায়গায় লাগানো প্রয়োজন, তাহার একটি স্পষ্ট রূপরেখা স্থির করা দরকার। পরিচর্যার অভাবে এবং অবাস্তব সৌন্দর্যায়নের চাপে ইতিপূর্বে বহু গাছের অপমৃত্যু ঘটিয়াছে। পরিকল্পনা করিয়াই এত দিন ধ্বংস করা হইয়াছে পরিবেশ, এখন তাহাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরাইতে হইলে সেই পরিকল্পনার পথেই ফিরিতে হইবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement