Indian Economy

নতুন ও সনাতনী বিশ্বায়ন: কোন পথে বিপন্ন হতে পারে ভারতের মতো দেশ

বিশ্ববাণিজ্যের গতি বিশ্বের জিডিপি-র তুলনায় ধীর হতে শুরু করেছে। এই বিষয়টা একটা দীর্ঘকালীন প্রবণতাকে উল্টে দিয়েছে।

Advertisement

টি এন নাইনান

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২১ ১৫:৪৭
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বিশ্বায়নের সনাতনী চেহারাটা (যেমন পণ্যের অবাধ আমদানি ও রফতানি, অর্থ ও মানুষের অবাধ বিচরণ) ভাল ভাবে দেখলে বোঝা যায়, তা অংশত পশ্চাদপদ। কিন্তু বিশ্বায়নের চরিত্র ক্রমশ বদলে যাচ্ছে এবং তার মধ্যে নতুন নতুন বিষয় দেখা দিচ্ছে। এই নতুন বিষয়গুলি হল জলবায়ুগত পরিবর্তন, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সংস্থাগুলির উপর নতুন কর ব্যবস্থা চালু করা, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে মোকাবিলা, টিকা বা ওষুধের আদান প্রদান ইত্যাদি। বিশ্বায়ন ব্যবস্থা দেশগুলিকে যত বেশিমাত্রায় পরস্পরের কাছাকাছি ঠেলে দিচ্ছে, ততই সীমান্ত অতিক্রমকারী সমস্যাগুলিও একত্র হচ্ছে। এমনকি, সনাতনী বিশ্বায়ন ব্যবস্থার বাঁধন শিথিল হয়ে পড়ছে। বিশ্বায়নের সনাতনী বা সাবেক রূপটা ভারতের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে শুভ ছিল। কিন্তু বিশ্বায়নের নয়া অবতার একই সঙ্গে কিছু ভাল আর কিছু খারাপকে সামনে নিয়ে এসেছে।

Advertisement

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিশ্ববাণিজ্যের গতি বিশ্বের জিডিপি-র তুলনায় ধীর হতে শুরু করেছে। এই বিষয়টা একটা দীর্ঘকালীন প্রবণতাকে উল্টে দিয়েছে। গত সাত বছরে এক বার মাত্র বিশ্ব অর্থনীতির তুলনায় পণ্য-বাণিজ্যের পরিমাণগত বৃদ্ধি দেখা দিয়েছিল। ২০১৯ সালে বিশ্ববাণিজ্যে এক দশকের মধ্যে প্রথম বার লক্ষণীয় ভাবে পতন দেখা দেয় এবং ২০২০ সালে অতিমারির কারণে এই পতন আবার দৃশ্যমান হয়। ভারত-সহ অন্য দেশগুলিতে ‘আরক্ষা প্রাচীর’ গড়ে তোলা হতে থাকে। এ বার মানুষের অবাধ বিচরণের বিষয়টি দেখা যাক। বিশ্বের সামগ্রিক অভিবাসী সংখ্যার অর্ধেকটাই ইওরোপ ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশের। অল্প হলেও এই সংখ্যাটা কমেছে। বিগত ৭০ বছর ধরে অভিবাসন প্রবণতার পালে যে উদারনীতির বাতাস লাগিয়েছিল ব্রেক্সিট এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি তার গতিপথ সম্পূর্ণ রূপে উলটে দেয়। বেশ কিছু এশীয় দেশও ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি শুরু করে।

ভারত বিশ্বের অভিবাসী শ্রম-উৎসের প্রধান দেশ।

এই নতুন প্রবণতাগুলি দৃঢ় হয়ে দেখা দিলে ভারতের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। ভারত বিশ্বের অভিবাসী শ্রম-উৎসের প্রধান দেশ। এক অর্থে ভারত অভিবাসী গ্রহণেও প্রথম স্থান অধিকার করে। এবং অধিকতর মুক্ত বিশ্ববাণিজ্য গত তিন দশকে ভারতকেকে বিপুল পরিমাণ সুবিধা দিয়েছে। এখনও পর্যন্ত সুযোগের বাতায়নপথ খোলা রয়েছে। অনেক দেশই এই মুহূর্তে বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদক ও বণিকশক্তি চিনের উপর নির্ভরশীলতা ত্যাগ করতে ইচ্ছুক হয়ে ঊঠেছে। ভারত এই সুযোগকে পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু কে দ্রুত এগিয়ে আসে, তার দিকে অন্যান্য দেশগুলিও তাকিয়ে রয়েছে। এই পর্যায়ে বিশ্বায়নের অন্যান্য বিষয়-আশয় যে অব্যাহত থেকেছে, তা বলা বাহুল্য। যেহেতু ভারত একটা বড় পুঁজি আমদানিকারক দেশ, সেহেতু পুঁজির অবাধ গতি তার পক্ষে উপযোগী। এই সময়েই নতুন প্রযুক্তির সেই প্রভাব এসে পড়ে। যাকে আমেরিকান রাজনীতি-ভাষ্যকার টমাস ফ্রিডম্যানের তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে ‘ফ্ল্যাট ওয়ার্ল্ড’ বা ‘সমতল বিশ্ব’ বলা যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বেঙ্গালুরুর একজন হিসাবরক্ষক বস্টনের কারওর আয়করের হিসেব কষে দিতে পারেন। কলকাতার একজন রেডিয়োলজিস্ট লন্ডনের কোনও রোগীর স্ক্যান রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে চিকিৎসার নিদান দিতে পারেন। এই পর্যায়ে ভারতের আয়কর পরিষেবা কোনও সমস্যা বা বাধার মুখে কিন্তু পড়েনি।

Advertisement

বিশ্বায়নের দ্বিতীয় পর্যায়ে পরিস্থিতি অন্য দিক থেকে দেখলে কী দাঁড়াল? আপাতত সরকারি নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেই এর প্রভাব দেখা গিয়েছে। কিছুটা সময় পেরোলে দেশগুলির বাণিজ্যের উপর এর প্রভাব বোঝা যাবে। ভারতের ক্ষেত্রে সরকারি নীতি নির্ধারণ কোনও বড় খবর নয়। কারণ, এই দেশ গোড়া থেকেই নীতি গ্রহণ এবং নির্ধারণ করে এসেছে। তেমন ক্ষেত্রে তার উপযোগ আর সেই সংক্রান্ত খরচ সমাপতনিক হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়। এই পর্যায়ে আন্তর্জাতিক কর্পোরেট কর ব্যবস্থায় এক নতুন যুগ শুরু হয়। এখন যে দেশ থেকে বেশি রাজস্ব পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে করের হার কম করে ধরা হতে থাকে। এতে ভারতের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু এই নয়া ব্যবস্থার প্রাথমিক সুবিধা ভোগকারী কার্যত হয়ে দাঁড়ায় ধনী দেশগুলিই।

এ দেশে বেশি পরিমাণে টিকা সরবরাহের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জি-৭ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অধিকতর ধনী দেশগুলির সায় তেমন উল্লেখযোগ্য নয়

জলবায়ুগত পরিবর্তনের নীতি নির্ধারণের বিষয়টি আরও বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির এক উৎসাহী প্রয়োগকর্তা হলেও ভারত কয়লা-ভিত্তিক শক্তিচালিত পুরনো প্রযুক্তিকে সরিয়ে নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনও সহায়তা (আর্থিক ও প্রযুক্তিগত) পায়নি। পাবে বলেও মনে হয় না। কিন্তু একই সঙ্গে সেই সব দেশ ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে, যারা কার্বনঘটিত গ্যাস নিঃসরণের ব্যাপারে শীর্ষস্থানে রয়েছে। এমনকি, এ দেশে বেশি পরিমাণে টিকা সরবরাহের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জি-৭ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অধিকতর ধনী দেশগুলির সায় তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। সেখানে কোভিড টিকার ক্ষেত্রে পেটেন্টের ছাড়পত্র পেতে ভারতের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। যেখানে বিশ্বায়নের নবতরঙ্গের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিহিত, সেটি হল নেটমাধ্যম। যে সব দানবাকৃতি প্রতিষ্ঠান এই ক্ষেত্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করে, তারা ইতিপূর্বে খোলাহাত পেয়েছে। কিন্তু তাতে দিনে দিনে বিপন্ন হয়েছে ভারত-সহ বহু রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব। ভুবনায়িত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভুবনায়িত নীতি নির্ধারণের বিষয়ে এটি একটি মোক্ষম উদাহরণ। এতে যদি ক্ষমতাবান স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির উত্থানের পথ প্রশস্ত হয়ে থাকে, তবে তা আরও গুরুতর চ্যালঞ্জের সামনে বিশ্বকে নিয়ে আসবে। পুরো বিষয়টির গুরুত্ব নির্ভর করছে কী ভাবে সেটি নেওয়া হচ্ছে তার উপরেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement