নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র
নরেন্দ্র মোদীর বোধ করি রাগ হইয়াছে। অভিমানও। দেশ জুড়িয়া সরকারপক্ষের সমর্থনে ‘এত মিছিল’ হইতেছে, ‘এত সুবিপুল’ তাহার আয়তন, কোথাও ‘পঞ্চাশ সহস্র’ তো কোথাও ‘লক্ষাধিক’-এর জনসমাবেশ, অথচ প্রতি দিনই দশ-পনেরোটি করিয়া সরকারবিরোধী আয়োজন দেখাইতেই ব্যস্ত দেশের সংবাদমাধ্যম! এই পর্বতপ্রমাণ অবিচার প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মানিয়া লওয়া দুষ্কর হইতেছে। অতএব কর্মিসভায় তিনি ঘোষণা করিয়াছেন, সংবাদমাধ্যম হইতে সমর্থন মিলিবার আশা নাই, এবং সেই সমর্থনের উপর তাঁহারা নির্ভরও করেন না। বাক্যটির দ্বিতীয় ভাগে গভীর ব্যঞ্জনা নিহিত আছে। বিগত ছয় বৎসর ধরিয়া সংবাদমাধ্যমের পরিসরের অনেকখানি জুড়িয়া নরেন্দ্র মোদীর সরকার তথা দলের গুণকীর্তন সুপরিচিত। কেবল সংবাদমাধ্যম নহে, আপনার প্রচারার্থে চলচ্চিত্র হইতে বেতার, এবং অতি অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়া— সকল মাধ্যমে যথোপযুক্ত প্রচার করাই তাঁহাদের রীতি। রাজনীতির অঙ্গও বটে। এখন সহসা প্রধানমন্ত্রী এমন ট্রাম্প-সুলভ কথা বলিলে কিঞ্চিৎ চমকপ্রদ শোনায় বইকি।
‘রাজসিংহ’ উপন্যাস পুনর্নির্মাণের পর ভূমিকায় বঙ্কিমচন্দ্র বলিয়াছিলেন, কেহ যেন মনে না করেন যে হিন্দু-মুসলমানের তারতম্য নির্দেশ করা উক্ত গ্রন্থের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ, উপন্যাসে তারতম্য নির্দিষ্ট হইবার শঙ্কা আছে। কিংবা তারতম্য নির্দেশ করাই হয়তো উদ্দেশ্য ছিল! অস্বাভাবিকতার কোনও প্রশ্ন না থাকিলে স্বাভাবিক জ্ঞান জোর দিয়া বলিবার কারণ কী? নরেন্দ্র মোদীর কণ্ঠে যখন সংবাদমাধ্যম বিষয়ে অভিমান বা ক্ষোভের সুর ধ্বনিত হয়, তখন এই সংশয় স্বাভাবিক যে, অস্বস্তির কারণ ঘটিয়াছে। অনুমান করা চলে, সংবাদমাধ্যমগুলিকে অপরিচিত বেসুরে গাহিতে দেখিয়া— হয়তো বা কিঞ্চিৎ অসতর্ক মুহূর্তেই— কথাটি বলিয়া ফেলিয়াছেন মাধ্যম-বান্ধব নায়ক।
কিন্তু এমত পরিস্থিতি, যাহা বস্তুত অবস্থান্তর, তাহার সৃষ্টি হইল কী রূপে? সরকার বা শাসক দল যাহা করিতেছে, ক্রমাগত প্রশ্নহীন ভাবে তাহাকে সমর্থন করিয়া যাইবার সমস্যা আছে। শাসক দলের রাজনীতির বিপক্ষে দেশ জুড়িয়া যে আবেগ তৈয়ারি হইয়াছে, তাহা এতটাই জোরদার এবং প্রকট যে তাহাকে অস্বীকার করা কঠিন। যে দলহীন এবং স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে সমগ্র দেশের মানুষ শামিল হইতেছেন, তাহাকে স্বীকার করা নৈতিক ভাবেও আবশ্যক, বাস্তববুদ্ধির কারণেও প্রয়োজনীয়। সংবাদমাধ্যমের পক্ষে বিশ্বাসযোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। অনুমান করা যায়, সেই বিশ্বাসযোগ্য থাকিবার তাগিদই সাম্প্রতিক সংবাদ-প্রবণতায় প্রতিফলিত হইয়া প্রধানমন্ত্রীর বিরাগ উৎপাদন করিয়াছে। তাহার অধিক কোনও সিদ্ধান্ত করা, বিশেষত ‘ভয় ভাঙিয়া গিয়াছে’ ধরিয়া লওয়া বিবেচনার কাজ হইবে না। এখনই নিশ্চিত বা নিশ্চিন্ত বোধ করিবার কিছুমাত্র কারণ নাই। গণতন্ত্রের পথ কখনওই কুসুমাস্তীর্ণ নহে, বর্তমান ভারতে তাহা কণ্টকাকীর্ণ বলিলে কমই বলা হয়। তবে, গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলিতে সুপরিবর্তনের একটি ক্ষীণ আশা হয়তো করা যায়। শাসকেরা হয়তো বুঝিতেছেন, অনন্তকাল সমাজের সকল স্তরের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখা কঠিন। হয়তো সেই বোধের তাড়নাতেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সরাসরি সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছেন। হয়তো।