ফাইল চিত্র
প্রধানমন্ত্রী জানাইয়াছেন, ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় ইতিউতি ফের নূতন প্রাণের সঞ্চার হইতেছে। কোন তথ্য, কোন পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন, প্রধানমন্ত্রী জানান নাই। কেহ বলিতেই পারেন, তথ্যসূত্র উল্লেখ করা তাঁহার কাজ নহে, প্রধানমন্ত্রীর হাতে অত সময় থাকে না। কথাটি মানিয়া লওয়া যাইত, যদি অর্থমন্ত্রী বা সচিব প্রধানমন্ত্রীর কথার সারবত্তা প্রমাণের দায়িত্ব লইতেন; তাহার সপক্ষে পরিসংখ্যান, তথ্য পেশ করিতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, শুধু লকডাউনের সময়কালেই নহে, গত তিন বৎসর যাবৎ একটি ভিন্ন প্রবণতা দেখা যাইতেছে— কোনও তথ্যসূত্র ব্যতীতই প্রধানমন্ত্রী বলিয়া দেন, সব ঠিক আছে; এবং তাহার পর ‘প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, অতএব তাহা সত্য’, এই যুক্তি মানিয়া প্রত্যেকেই সেই আশ্বাসবাণীর পুনরাবৃত্তি করিতে থাকেন। অর্থব্যবস্থার হাল যে তাহাতে শুধরায় না, একের পর এক ত্রৈমাসিকের পরিসংখ্যান তাহার প্রমাণ দিবে। অতএব, প্রধানমন্ত্রীর ‘গ্রিন শুট’-দর্শন লইয়াও সন্দিগ্ধ হইবার কারণ আছে। আশঙ্কা হইতেই পারে, পূর্বে যেমন তিনি ‘অ্যানিম্যাল স্পিরিট’ বা ‘ফান্ডামেন্টালস অব দি ইকনমি’ জাতীয় গালভরা কথা সম্পূর্ণ অর্থহীন ভাবে ব্যবহার করিয়াছেন, এই দফাতেও প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারণে তাহার অধিক সারবত্তা নাই।
উত্তাল দরিয়ায় অর্থনীতির জাহাজ যখন বিপর্যস্ত, তখন কান্ডারি ছেলে ভুলাইতে ব্যস্ত, এই কথাটি ভারতীয়দের পক্ষে সুসংবাদ নহে। গভীরতর চিন্তার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী শুধু দেশবাসীকেই নহে, বিদেশি লগ্নিকারীদেরও আশ্বস্ত করিতে চাহেন। যাবতীয় পরিসংখ্যান যখন সুগভীর বিপদের কথা ঘোষণা করিতেছে, তখন প্রধানমন্ত্রী বারংবার আশাবাদী হইলে সেই লগ্নিকারীদের সংশয় হইতেই পারে, তিনি বাস্তবকে অস্বীকার করিবার বিভ্রমে আক্রান্ত— ইংরাজিতে যাহাকে বলে ‘ডিনায়াল’। লগ্নিকারীরা ভরসা না পাইলে বিস্ময়ের কারণ নাই। বিশেষত সেই সময়ে, যখন সব আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থাই ভারতের রেটিং কমাইয়াছে। স্পষ্ট বলিয়াছে, ভারতীয় অর্থনীতির মূল সমস্যা কাঠামোগত— তাহার দায় সরকারের উপরই বর্তায়। যে সময়ে আন্তর্জাতিক পুঁজি ভারতের আর্থিক ভবিষ্যৎ বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করিতেছে, তখনই প্রধানমন্ত্রীর এই ভিত্তিহীন আশাবাদ সমস্যাকে আরও গভীর করিবে বলিয়াই আশঙ্কা। ভারত বিদেশি লগ্নিকে অভ্যর্থনা জানাইতে প্রস্তুত বলিলেই কাজ শেষ হয় না— সেই লগ্নি আদৌ ভারতে আসিবে কেন, এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তরও থাকা প্রয়োজন।
দুর্ভাগ্য, বিপরীত সম্ভাবনা— অর্থাৎ ভারতে লগ্নি কেন আসিবে না— তাহার পক্ষে সুস্পষ্ট যুক্তি রহিয়াছে। তাহার একটি বৃহৎ উদাহরণ একাধিক মোবাইল নেটওয়ার্ক সংস্থার বিরুদ্ধে অ্যাডজাস্টেড গ্রস রেভিনিউ বা এজিআর-সংক্রান্ত মামলা। ১৯৯৯ সালে জাতীয় টেলিকম নীতিতে রেভিনিউ শেয়ারিং বা লভ্যাংশ ভাগের যে পদ্ধতি নির্ধারিত হইয়াছিল, সরকার সেই নীতি হইতে বিচ্যুত হইয়াছে বলিয়াই টেলিকম সংস্থাগুলির অভিযোগ। তাহার ভিত্তিতেই ২০০৩ সালের মামলা। মহামান্য আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও স্মরণ করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন, সরকারের সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতার অভাব যেমন প্রকট, তেমনই কেহ অভিযোগ করিতে পারেন, সরকার যে ভাবে অনমনীয় অবস্থান লইয়াছে, তাহাতে একটি বিশেষ সংস্থাকে বাড়তি সুবিধা করিয়া দেওয়ার তাগিদ স্পষ্ট। সাম্প্রতিকতর উদাহরণ হইল, একটি বিশেষ নেটওয়ার্কের প্রিমিয়াম প্যাক লইয়া ট্রাই-এর আপত্তি। তাহাতেও পক্ষপাতের গন্ধ প্রবল। সরকারের অবস্থান ন্যায্য কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন; কিন্তু তাহাকে কেন্দ্র করিয়া যদি পক্ষপাতের এমন অভিযোগ, বা এ হেন অনিশ্চয়তা থাকে, তবে নূতন লগ্নিকারীরা ভারতকে নিরাপদ জ্ঞান করিবেন কি? প্রধানমন্ত্রী ভাবিতে পারেন।