নবান্ন। — ফাইল চিত্র
পঞ্চায়েত কেন খুঁড়াইয়া চলিতেছে, সে বিষয়ে জেলাশাসকদের রিপোর্ট চাহিয়াছে নবান্ন। ‘ইহা হইবারই ছিল’ এমন কথা সম্ভবত কাহারও রিপোর্টে মিলিবে না। অথচ তাহাই কি সত্য নহে? স্থানীয় প্রশাসনে বিরোধীকে গুরুত্ব দিয়াছে রাজ্যের পঞ্চায়েত আইন। এমনকি পরাজিত প্রার্থীকেও স্থান দিয়াছে গ্রাম সংসদে। উন্নয়নের পরিকল্পনায় গ্রামের সকল মানুষের যোগদান, আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত— কেবল নীতিবাক্য নহে, ইহা গ্রাম পঞ্চায়েত চালাইবার বিধি। তৃণমূল আমলে বিরোধীকে মান্য করা হয় নাই, কোণঠাসা করা হইয়াছে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীদের প্রতি শাসক দলের হিংস্রতা তাহার চূড়ান্ত পরিণতি। তাহার পর স্থানীয় প্রশাসন কী রূপে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিতে পারে? সংবাদে প্রকাশ, সরকারি সূত্র অনুসারে অন্তত পনেরো শতাংশ পঞ্চায়েতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রবেশ করিতে পারিতেছেন না। সাধারণ নির্বাচনের মাসাধিক কাল পরেও অনেক গ্রামপঞ্চায়েত ছন্দে ফিরে নাই। প্রশাসনের দৃষ্টিতে ইহা মহা বিপত্তি, কারণ উন্নয়নের বিবিধ প্রকল্পের পূর্বনির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণ হইবে না, বিবিধ সূচকে রাজ্য পিছাইয়া যাইবে। নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়িলেই বিভিন্ন সরকারি দফতরে কাজের গতি শ্লথ হইয়া আসে। বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ফাইল জমিতে থাকে, বহু সংস্কার থমকাইয়া থাকে। স্বাভাবিক কর্মচক্র অচিরে সচল না হইলে বিপদ। শাসক দলের নিকট রাজনৈতিক দৃষ্টিতেও এই অচলাবস্থা শিরঃপীড়ার কারণ। সাম্প্রতিক নির্বাচনে রাজ্যবাসীর এক বড় অংশের অসন্তোষ স্পষ্ট হইয়াছে। সমর্থন ফিরিয়া পাইতে হইলে তাহাদের নিকট সরকারি সুযোগ-সুবিধা পৌঁছাইতে হইবে। কিন্তু সরকারি প্রকল্পের রূপায়ণ শুরু না হইলে কাজ হইবে কী রূপে?
সর্বাধিক সমস্যা গ্রামীণ মানুষের। তাহাদের জীবনে পঞ্চায়েতের গুরুত্ব কেবল সরকারি প্রকল্পের কারণে নহে। গ্রামের আর্থিক ও সামাজিক জীবনে পঞ্চায়েতের ভূমিকা বিচিত্র ও বহুমুখী। বিবিধ দ্বন্দ্বের নিরসনে, সঙ্কটের সমাধানে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়। মত বিনিময় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মঞ্চ হিসাবে মান্যতা পাইয়াছিল গ্রাম পঞ্চায়েত। বিভিন্ন সরকারি দফতরের প্রতি গ্রামের মানুষের ক্ষোভ তীব্র হইলে, তাহাদের স্বার্থরক্ষায় রাজ্য সরকারের নিকট তদবির করিতে হইলে, পঞ্চায়েতই বরাবর মধ্যস্থতা করিয়াছে। এতদ্ব্যতীত জন্মের সার্টিফিকেট হইতে গৃহকরের রসিদ পর্যন্ত অগণিত দৈনন্দিন কাজের জন্য পঞ্চায়েতের দ্বারস্থ হইতে হয় গ্রামের মানুষকে।
দরিদ্রের জীবনধারণ অনেকাংশেই পঞ্চায়েতনির্ভর। এই মুহূর্তে চাষি পরিবারে আর্থিক সঙ্কট ঘনাইয়া আনিতেছে খরা। এক্ষণে কি পঞ্চায়েত প্রধানের পলাইয়া বেড়াইবার সময়? নবান্ন তাহার উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণ করিতে পারিল কি না, তাহার অধিক গুরুতর, গ্রামের জনপ্রতিনিধি গ্রাম হইতে উচ্ছেদ হইলে আগামী চার বৎসর গ্রামীণ প্রশাসনের কী হইবে। পঞ্চায়েত সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠিতেছে তাহা সত্য কি না, তাহার মীমাংসা হয়তো সহজ নয়। কিন্তু বিপর্যয় তো শুধু সদস্যদেরই নহে। গ্রামের মানুষের দুর্ভোগ বাড়িতেছে। ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক দিয়া গ্রামীণ উন্নয়ন সম্ভব নহে বলিয়াই নব্বইয়ের দশকে পঞ্চায়েতের পত্তন হইয়াছিল। বহু দুঃখে পুরাতন পাঠ পুনরায় পড়িতে হইবে।