মোদীর পক্ষে মুসলমানদের আস্থা অর্জন করা নেহাত সহজ নয়

হঠাৎ সংখ্যালঘু-দরদ কেন

রাজনীতিআমরা ২৩৫, ওরা ৩০। কী করবে ওরা?’ ২০০৬-এ বিপুল ভোটে বামফ্রন্টের জয়ের পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কণ্ঠে সে দিন অনেক কিছু মিশে ছিল। দম্ভ, আত্মতুষ্টি। বিরোধীদের তাচ্ছিল্য, উপেক্ষা।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৯ ০০:০০
Share:

আমরা ২৩৫, ওরা ৩০। কী করবে ওরা?’ ২০০৬-এ বিপুল ভোটে বামফ্রন্টের জয়ের পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কণ্ঠে সে দিন অনেক কিছু মিশে ছিল। দম্ভ, আত্মতুষ্টি। বিরোধীদের তাচ্ছিল্য, উপেক্ষা।

Advertisement

মার্কেজ়-ভক্ত বুদ্ধদেবের মুখে এমন কথা হয়তো প্রত্যাশিত ছিল না। তবু বলেছিলেন। কালের নিয়মে।

এ বার ২০১৯-এ লোকসভা ভোটে বিপুল আসনে জয়ের পর নরেন্দ্র মোদী যদি বলতেন, ‘আমরা ৩৫৩, কী করবে ওরা?’, কেউ কি অবাক হতেন? হতেন না বোধ হয়।

Advertisement

কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ও সব কথা বললেন না। তার বদলে বিজেপি ও এনডিএ শরিক দলের ৩৫৩ জন সাংসদকে নির্দেশ দিলেন, এ বার সংখ্যালঘুদের আস্থা জিততে হবে। খাতায় কলমে মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, পারসি, জৈন— সকলেই সংখ্যালঘু। নরেন্দ্র মোদী বোঝাতে চাইলেন মুসলিমদের কথাই। বললেন, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর সঙ্গে নতুন মন্ত্র, ‘সবকা বিশ্বাস’। নরেন্দ্র মোদী এ-ও বললেন, যাঁরা বিজেপিকে ভোট দেননি, তাঁদের জন্যও কাজ করতে হবে। কোনও রকম প্রতিহিংসা চলবে না।

২৫ মে-র সেন্ট্রাল হলের গ্যালারি থেকে সে দিন দেখছিলাম, অনেক বিজেপি সাংসদেরই চোখে-মুখে বিস্ময়। ঠিক শুনছেন তো? খোদ অমিত শাহও গালে হাত রেখে টেবিলের উপর ঝুঁকে নরেন্দ্র মোদীর

দিকে তাকালেন।

ভুল শোনেননি কেউই। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদীর সরকার কতখানি গরিবদের জন্য কল্পতরু হল, কতখানি আর্থিক সংস্কার করল—সে সব মাপার চেষ্টা তো হবেই। কিন্তু ২০১৯-এর দিল্লিতে বসে মনে হচ্ছে, আজ থেকে পাঁচ বছর পরে নরেন্দ্র মোদী ফের ভোটের পরীক্ষায় বসলে প্রথম প্রশ্নই আসবে, সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস অর্জনের কাজ কতখানি হল!

সত্যিই কি সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস জয় করতে চান? না কি, এ তাঁর ভাবমূর্তি বদলানোর মরিয়া চেষ্টা? আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তাঁকে ‘ডিভাইডার ইন চিফ’ আখ্যা দেয়। সেই বিভাজনের রাজনীতির প্রধান কারবারির তকমাই এ বার ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী? তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারে ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গার কালো দাগ মুছে ফেলতে চাইছেন? দাঙ্গা রুখতে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে ‘রাজধর্ম’ পালন না করার অভিযোগ ভুলিয়ে দিতে চাইছেন? সবটাই কি ‘ইমেজ মেকওভার’-এর সুচিন্তিত কৌশল?

প্রশ্নটা অহেতুক নয়। বিজেপির ৩০৩ জন সাংসদ জিতে এসেছেন। তার মধ্যে মুসলিম? না, এক জনও নেই। মন্ত্রিসভায় এক জন মুসলিম। সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি। তিনি রাজ্যসভার সদস্য। প্রশ্নটা উঠবেই, ভোটের আগে কি তা হলে নরেন্দ্রভাইয়ের সংখ্যালঘু আস্থা অর্জনের কথা মনে পড়েনি? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, কোন পথে দেশের ১৫ কোটি মুসলমানের আস্থা অর্জন করবেন

নরেন্দ্র মোদী?

পাঁচ বছর পিছনে ফিরে যাই। ২০১৪-র ১৫ অগস্ট। লাল কেল্লার র‌্যামপার্ট থেকে বর্ণময় পাগড়ি মাথায় নতুন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আপাতত

সব বিভাজনের রাজনীতি বন্ধ থাক। নজর থাকুক শুধু উন্নয়নে।

বাস্তবে গত পাঁচ বছরে গোরক্ষার নামে মুসলিমদের পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। দাদরির মহম্মদ আখলাক থেকে আলওয়ারের পেহলু খান— তালিকা দীর্ঘ হয়েছে। ‘লাভ জেহাদ’, ‘ঘর ওয়পসি’র মতো শব্দ রাজনৈতিক বিতর্কের মূল স্রোতে পাকা জায়গা করে নিয়েছে।

এ বারও, নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশের পরেও, দেশের নানা প্রান্ত থেকে খবর মিলছে, মুসলিমদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হচ্ছে। মাথায় টুপি পরতে মানা করা হচ্ছে। প্রতিবাদের টুঁ শব্দটি করলে মারধর জুটছে।

না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে কোনও

বিজেপি সাংসদ সেখানে ছুটে গিয়েছেন— এমন সংবাদ মেলেনি।

নরেন্দ্র মোদী কি তা হলে নিছক মুসলিমদের ভোট টানার রাজনীতি করছেন? তা দেখিয়ে উপরি পাওনা হিসেবে তিনি উদার মনোভাবাপন্ন হিন্দুদেরও ভোট পেতে চাইছেন?

তা-ও বলা যায় না। কারণ দু’টি। এক, মুসলিমদের ভোট জয়ের চেষ্টা ছাড়াই তিনি ৩৫৩ আসনে জিতে এসেছেন। মুসলিমদের ভোট না হলে তাঁর চলছে না, এমন নয়। বরং মুসলিমদের ভোট টানার চেষ্টা করতে গেলে বিজেপির গোঁড়া হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক চটে যেতে পারে।

দুই, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী একেবারেই মুসলিমদের ভোট পাননি, এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। পরিসংখ্যান বরং উল্টো কথাই বলে। দশ বছর আগে মনমোহন সিংহের সরকার দেশের ৯০টি জেলাকে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বলে চিহ্নিত করেছিল। যেখানে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ২৫ শতাংশের বেশি। এই ৯০টি জেলাই আর্থ-সামাজিক সূচকে পিছিয়ে। এই ৯০টি জেলার ৭১টি লোকসভা আসনের মধ্যে বিজেপি এ বার ৪১টি দখল করেছে।

কিন্তু ভোট আর আস্থা যে এক নয়— তা নিশ্চিত ভাবে নরেন্দ্র মোদীও জানেন। আস্থার বদলে যে

গত পাঁচ বছরে মুসলিমদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, সেই আতঙ্কের কথা জানালেই যে ‘পাকিস্তানে চলে যাও’-এর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, তা-ও তিনি জানেন।

কোন পথে মুসলিমদের আস্থা অর্জন করবেন নরেন্দ্র মোদী?

প্রধানমন্ত্রী সে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, মুসলিমদের স্বাস্থ্য, শিক্ষায় আরও বেশি জোর দেওয়া দরকার।

স্বাস্থ্য-শিক্ষার নিরিখে, সামগ্রিক ভাবে আর্থ-সামাজিক নিরিখেই যে দেশের মুসলিমরা কয়েক অযুত মাইল পিছিয়ে রয়েছে, তাতে কোনও সংশয় নেই। বিজেপির পুরনো নীতি হল, সংখ্যালঘু তোষণ করা হবে না। অর্থাৎ, আলাদা করে মুসলিমদের জন্য কিছু করা হবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি শুধু গরিবদের জন্যই কাজ করবেন। সে কাজের সুফল যেমন অন্য সব জাত-ধর্মের গরিবরা পাবেন, তেমনই মুসলিমরাও পাবেন। মুসলিমদের বঞ্চিত করা হবে না।

শুনতে খুবই ভাল। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র।

গরিবের উপকার করলেই তাঁর বিশ্বাস পাওয়া যায় না। তাঁকে সংবিধানে প্রদত্ত আর সব স্বাধীনতার ব্যবস্থাও করে দিতে হয়। বাক্‌স্বাধীনতা, নিজের ধর্ম-আচার, জীবন, জীবিকার মৌলিক অধিকার। সংখ্যালঘু বলে তাঁকে দমিয়ে, ভয় পাইয়ে রাখা চলবে না। নরেন্দ্র মোদী সংবিধানে মাথা ছুঁইয়ে ‘সবকা বিশ্বাস’-এর মন্ত্র পাঠ করেছেন। কিন্তু আরএসএস-প্রচারকদের ঝোলায় পুরে রাখা রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার

তুলে দেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতি তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না তো?

রাম মন্দির নিয়ে মোদী সরকারের এখনও পর্যন্ত অবস্থান, সুপ্রিম কোর্ট যেমন নির্দেশ দেবে, তেমনটাই হবে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মুখে বলা যতখানি সহজ, তার রূপায়ণ ততখানিই কঠিন। অনেক ইসলামি রাষ্ট্রেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু রয়েছে। কিন্তু এ দেশে এ হেন বিধি হিন্দুরাই মেনে নেবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। আইন কমিশনই বলেছে, এ দেশে এখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কাঙ্ক্ষিত বা সম্ভবপর নয়। জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার দেওয়া ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনেকটাই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের বিষয়। জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা তাতে সায় দিলেই ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়া সম্ভব।

কিন্তু এর কোনও একটিও জোর করে চাপানোর চেষ্টা করলে, মুসলিমদের কাছে ভুল বার্তা যাবে। দেশ ভাগের পর বহু মুসলিমই পাকিস্তানে যাননি। এ দেশেই থাকা নিরাপদ ভেবে রয়ে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান ধর্মীয় মৌলবাদকে আঁকড়ে ধরেছে। ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হেঁটেছে। বিভাজনের রাজনীতি থেকে সরে এসে, সত্যিই ‘রাষ্ট্রনায়ক’ হয়ে উঠতে চাইলে, ধর্মনিরপেক্ষতার রাস্তাতেই হাঁটতে হবে নরেন্দ্র মোদীকে। শুধু সংবিধানে মাথা ছুঁইয়ে নয়। সংবিধানের পাতায় চোখ রেখে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement