উপকূলবর্তী মানুষের মনে ‘মিগজাউম’ চিরকালের জন্য থেকে যাবে। ছবি: পিটিআই।
তামিলনাড়ুর উপকূলবাসী মানুষের কাছে প্রকৃতির তাণ্ডব সয়ে বেঁচে থাকাটা জীবনের অঙ্গ। কিন্তু উষ্ণায়নের কারণে সাইক্লোনের তাণ্ডব বেড়ে যাওয়ায় মিগজাউম যেন ঝড় সামলে বাঁচার অর্থকে চাবুক মেরে বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত, মায়ানমারের দেওয়া এই সাইক্লোনটির নামের অর্থ নাকি ‘সহনশীলতা’ এবং ‘মনোবল’।
তথ্য বলছে, ভারতের উপসাগরীয় অঞ্চলের সাইক্লোনের সংখ্যা বিশ্বের চার শতাংশ হলেও সাইক্লোনের কারণে প্রাণহানির অঙ্কে ভারতের অবদান ৮০ শতাংশ। তাই উপকূলবর্তী মানুষের কাছে সাইক্লোনের অন্য নাম ‘মিগজাউম’ হিসাবেই চিরকালের জন্য অভিধানে জায়গা করে নিতে পারে। আর কাকতালীয় ভাবেই মিগজাউম এমন সময় হানা দিল, যখন দুবাইয়ে উষ্ণায়ন ঠেকানোর রাস্তায় হাঁটার দর কষাকষির বৈঠকে বসেছে ‘কপ ২৮’-এর সদস্য দেশগুলি ।
মাথায় রাখতে হবে, পৃথিবীর ৭০ শতাংশই সমুদ্র। যা কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার অন্যতম ক্ষেত্র। একই সঙ্গে তা পৃথিবীপৃষ্ঠের উষ্ণতাকে সহনশীল মাত্রায় রাখারও অন্যতম ক্ষেত্রও বটে। সমস্যা হচ্ছে, সেই সমুদ্রও হাত তুলে নিয়েছে আমাদের সভ্যতাকে বাঁচানোর অন্যতম ক্ষেত্র হওয়ার এই দায় বহন করতে। কারণ, অবশ্যই আমরা।
আমাদের পরিমণ্ডলের ভারসাম্য বজায় রাখতে বাতাসের দূষণকে আকণ্ঠ পান করে সমুদ্র। আরও একটা কাজ আছে পৃথিবীর ৭০ শতাংশের এই অংশীদারের। পৃথিবীকে ঠান্ডা রাখার দায়ও তার নিজের। সমুদ্রের উপরিপৃষ্ঠ যখন গরম হয়, তখন তাকে ঠান্ডা করার জন্য সমুদ্রের তলা থেকে ঠান্ডা জলের স্রোত উপরে উঠে আসে। সমুদ্রের স্রোত আর উপরের বায়ুর স্রোতের মিশেলে যে প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশ তার শুদ্ধতা বজায় রাখে, তা আবহাওয়া বিজ্ঞানের পাঠ্য। তবে সাম্প্রতিক সব সমীক্ষাই বলছে, দূষণের সঙ্গে লড়াইয়ে তাল মিলিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার কাজ আর সমুদ্র করতে পারছে না। কারণ, আমাদের সভ্যতা বাতাসকে যে হারে দূষিত করে চলেছে, তা শোধন করা সমুদ্রের ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে।
বিশ্ব জলবায়ু সংস্থার চলতি বছরের রিপোর্ট অনুযায়ী এই ব্যর্থতার কারণে অতলান্তিক মহাসাগর একাই বিশ্বের সাম্প্রতিক উষ্ণায়নের ৩০ শতাংশের দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে ফেলেছে। সমীক্ষা বলছে, এই ব্যর্থতার কারণেই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০ মিটার গভীর পর্যন্ত জলের উষ্ণতা বেড়েই চলেছে। যা ২০১৪ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দশককে ইতিহাসের উষ্ণতম হিসাবে দাগিয়ে দিয়েছে। আর তার ফলে তৈরি হচ্ছে এক মারণ-বৃত্ত। ক্ষমতার অতিরিক্ত দূষণ শোধন করতে না পারার ফলে এই উষ্ণতা বাড়ায় গলছে মেরুর বরফ, ত্বরান্বিত হচ্ছে সার্বিক উষ্ণায়ন প্রক্রিয়াও। আর সমুদ্রের জলে বাড়ছে অম্লতা। যা শুধু সামুদ্রিক প্রাণীজগৎকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে না, আমাদের কপালেও বন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছে।
বিভিন্ন উচ্চারণ সত্ত্বেও আমরা মাথায় রাখি না যে, বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোনের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এবং তার হানা মানছে না মরসুমের অঙ্কও। এই সময়টা প্রথাগত সাইক্লোনের সময় নয়। অথচ মিগজাউম এই সময়কেই তার ছোবলের সময় হিসাবে বেছে নিল। এর কারণ সেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণায়ন। সমীক্ষা বলছে, ৭০ শতাংশ পৃথিবীকে ঢেকে রাখা সমুদ্রপৃষ্ঠের ২৭ শতাংশই তাপপ্রবাহের বলি। অতলান্তিক মহাসাগর ভূপৃষ্ঠের ২০ শতাংশ ঘিরে রয়েছে আর তাতেই সে সার্বিক উষ্ণায়নের ৩৩ শতাংশের কারণ হয়ে উঠেছে।
‘কারণ হয়ে উঠেছে’ বলা ভুল। আমরাই আসলে এই কালকূটের স্রষ্টা। এই অঙ্কটা আমরা জানি। কিন্তু, বুঝি না। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়ায় যেমন ঝড় শুধু আমাদের প্রাণে মারছে না, ফসলও ধ্বংস করে দিচ্ছে অসময়ের আক্রমণে। একই সঙ্গে জলের অম্লতা বাড়ার কারণে মাছের উৎপাদন কমছে। ২০১৫ সালের এক সমীক্ষা বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মৎস্যজীবীরা কয়েক হাজার কোটি টাকার আয়ের সুযোগ হারিয়েছেন এই উষ্ণায়নের কারণেই।
উষ্ণায়নের কারণে ভারতের উপকূলের মৎস্যজীবীরা কত কোটি টাকা আয়ের সুযোগ হারিয়েছেন অথবা বেমরসুমি ঝড়ের কারণে কত কোটি টাকার কৃষিপণ্যের ক্ষতি হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট দীর্ঘকালীন কোনও সমীক্ষা হয়েছে কি না জানা নেই। কিন্তু ক্ষতির অঙ্ক যে বিশাল, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
তা হলে উপায়? উপায় একটাই। বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কমানো। কিন্তু, তা কমাতে গেলে আমাদের কৃষি থেকে রান্নার পদ্ধতি এবং শিল্পের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর এনভায়রনমেন্ট, সাসটেনেবিলিটি অ্যান্ড টেকনোলজি-র এক সমীক্ষা বলছে, আমাদের দেশে ৫০ লক্ষ ২০ হাজার টন ক্ষতিকারক পিএম২.৫ ধূলিকণা বাতাসে মেশে প্রতি বছর। আর এর ৮২ শতাংশ আসে নানান ধরনের বর্জ্য পোড়ানো এবং উৎপাদন শিল্পের কারণে।
সমস্যা হচ্ছে, এই দূষণ থামাতে গেলে প্রয়োজন প্রযুক্তির পরিবর্তন। আর তা করতে গেলে যে টাকার দরকার, তা শিল্পক্ষেত্র বহন করতে রাজি নয়। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম আর্থিক শক্তি হিসাবে নিজেদের জাহির করলেও দেশের কোষাগারেও সেই সম্পদ নেই, যা দিয়ে রাতারাতি ব্যবহৃত সব প্রযুক্তিকেই পরিবেশবান্ধব করে তোলা যায়। দুবাইয়ে কয়লার ব্যবহার কমানোর চুক্তিতে ভারতের সই করতে অস্বীকার করার অন্যতম কারণও সেই টাকার অভাব। আমাদের দেশে সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৭০ শতাংশের উপর আসে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি থেকে। যার বেশির ভাগই চলে কয়লায়।
পুরনো প্রযুক্তি সস্তা এবং পরিবেশের শত্রু। নতুন প্রযুক্তি যা তুলনামূলক ভাবে দূষণ কম করে, তার খরচ বেশি এবং তা উন্নত দুনিয়ার দখলে। এই কারণেই উন্নয়নশীল দেশগুলি দীর্ঘ কাল ধরেই দাবি করে আসছিল যে, পরিবেশ বাঁচানোর দৌড়ে যে খরচ করতে হবে, তার দায় উন্নত দেশগুলিকেই নিতে হবে। পরিবেশের বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে উন্নত দুনিয়ার কারণেই আর তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে সবাইকেই। উন্নয়নশীল দেশগুলোর তাই বক্তব্য হল, পরিবেশের ক্ষতি যারা করেছে তারাই এ বার তা ঠিক করার দায় বহন করুক।
দীর্ঘ কাল ধরে এ নিয়ে টালবাহানা চললেও, এ বারের দুবাইয়ের বৈঠকে এই দাবিকে মেনে পরিবেশ দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গঠন করা হয়েছে, যা পরিচালনা করবে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। গত বৈঠকেই এই তহবিল গঠন করা নিয়ে আলোচনা হয়। গত এক বছর ধরে আলোচনা চলার পরে এই তহবিলকে পূর্ণ রূপ দেওয়া হল।
কিন্তু, এই তহবিল পরিবেশ দূষণকে রুখতে পারবে না। তার কারণে যে আর্থিক ক্ষতি হবে, তা সামলাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু উষ্ণায়নের ফলে প্রকৃতির যে তাণ্ডব আমরা দেখছি, তার থেকে রক্ষা পাব কী করে? প্রশ্ন একটাই, আরও ক’টা বৈঠক লাগবে আমাদের সভ্যতার ধ্বংস ঠেকাতে? সোমালিয়া থেকে তামিলনাড়ু, এই প্রশ্ন কিন্তু সব ভুক্তভোগীর মুখেই। কিন্তু আশ্বস্ত করার মতো উত্তর মেলেনি এখনও!