ভারতবর্ষে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ আইনত নিষিদ্ধ। —ফাইল চিত্র।
উত্তরকাশী জেলার সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গ ধসে পড়ে সতেরো দিন আটকে থাকেন একচল্লিশ জন শ্রমিক। নানা ভাবে তাঁদের উদ্ধার করার চেষ্টা করা হচ্ছিল। বিভিন্ন বাধাবিপত্তিতে ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছনো সম্ভব হচ্ছিল না কিছুতেই। সব শেষে সাফল্য এসেছে ইঁদুর-গর্ত (র্যাট-হোল মাইনিং) প্রক্রিয়াতে।
সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে এখন কমবেশি সবাই জেনে গেছেন যে, ইঁদুরের কায়দায় গর্ত খোঁড়ার প্রক্রিয়াটি বিপজ্জনক, কারণ খনন করা সুড়ঙ্গ অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ হয়। ধস নেমে নিয়মিত শ্রমিকের মৃত্যুও ঘটে। ভারতবর্ষে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু নিষিদ্ধ পদ্ধতিতেই সাফল্য এসেছে উত্তরকাশীতে। প্রশংসিত হয়েছেন ‘র্যাট-হোল মাইনিং’-এ দক্ষ কর্মীরা।
অস্বস্তিকর কিছু প্রশ্ন কাঁটার মতো বেঁধে তবু। এই পুরো পর্বে ইঁদুর তবে কারা? যাঁরা হামাগুড়ি দিয়ে উদ্ধারকার্যের শেষ ১০-১২ মিটার সুড়ঙ্গ খনন করে পাইপ বসিয়েছেন? না কি তাঁরা, যাঁরা গত সতেরো দিন ধরে আটকে থেকেছেন সুড়ঙ্গের মধ্যে, হয়তো জীবন-জীবিকার তাগিদে আবার যোগ দেবেন সুড়ঙ্গ নির্মাণের কাজে? না কি দুই পক্ষই ইঁদুর, যাঁরা কখনও বুকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যান, আবার কখনও আটকে পড়েন প্রযুক্তি, প্রগতি তথা উন্নয়নের কলে? কেমন এই দমচাপা সুড়ঙ্গবদ্ধ জীবন?
যে সুড়ঙ্গে এই মানুষগুলি আটকে পড়েছিলেন, সাদা চোখে দেখলে সেটি সিমেন্ট, পাথর, লোহা দিয়ে তৈরি। কিন্তু আদতে দম আটকে যাওয়া, অন্ধকার এই সুড়ঙ্গের প্রধান উপকরণ দারিদ্র, বঞ্চনা এবং অসাম্য। এই রকম শত সহস্র সুড়ঙ্গে বাস করেন এই দেশের বহু কোটি মানুষ। তাঁরা নিত্য দিন মাথা নিচু করে স্বল্প পরিসরে, সীমিত প্রাণবায়ু নিয়ে শুধু পরিশ্রম করে চলেন; আর দেশ তাঁদের এই দমচাপা, প্রাণঘাতী শ্রমের উপর ভর করেই ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি হওয়ার পথে পা বাড়ায়।
মনুষ্যেতর জীবন যাপন করা এই মানুষেরা আমাদের আশেপাশেই আছেন। দারিদ্র এবং অসাম্য ভারী জগদ্দল পাথরের মতো চেপে রয়েছে এঁদের বুকের উপর। এঁদের মাথায় থাকে মহাজনের ঋণের ভার, প্রতিবেশী কৃষকের আত্মহত্যার স্মৃতি। আমরা যখন ট্রেনের বাতানুকূল কিংবা নিদেনপক্ষে স্লিপার ক্লাসে উঠি, এঁরা তখন বাক্সপ্যাঁটরা পরিবার-পরিজন নিয়ে সাধারণ কামরার তুমুল ভিড়ে কোনও রকমে পা রাখার চেষ্টা করেন। আসন্ন শীতের কথা ভেবে ছেঁড়া কম্বল রোদে দেন। ন্যূনতম মজুরির খোঁজে এঁরা রওনা হন অন্য রাজ্যে, মোটরবাইক বা সাইকেলে করে খাবার বা পণ্য বয়ে নিয়ে ছোটেন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এঁদের সন্তান অল্প বয়সেই স্কুল ছেড়ে কাজে হাত লাগায়। এঁদের মেয়েরা অনেকে পাচার হয়ে যায় চোরাগলিতে। জীবনের ইতর শ্রেণির মানুষ তো এঁরা সব। ছেঁড়া জুতো পায়ে বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করেন। পরিসংখ্যান মনে করায়, একক দেশ হিসাবে ভারতেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের বাস।
রাষ্ট্র এই সব ইঁদুর-মানুষকে দারিদ্র এবং অসাম্যের সুড়ঙ্গ থেকে বার করে আনার জন্য আদৌ কি আন্তরিক? উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গ দুর্ঘটনার এই সতেরো দিন আমরা এবং আমাদের নির্বাচিত শাসক কী করেছি তার হিসাব নিলেই আমাদের আত্মমুগ্ধতা স্পষ্ট হয়। আমরা দেশের মাটিতে বিশ্বকাপের আনন্দ উপভোগ করেছি, দেশ ফাইনালে হেরে গেলে কেঁদে আকুল হয়েছি। ধর্মীয় উৎসবের আনন্দে মেতেছি। আমাদের নির্বাচিত শাসক নিজের নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে গিয়ে ক্রিকেট দেখেছেন, নির্বাচনী প্রচারে জবরদস্ত বক্তৃতা দিয়েছেন। ইঁদুরের মতো তখনও আটকে ছিলেন একচল্লিশ জন শ্রমিক।
তবু কী ভাবে যেন আমাদের এই ‘সকলই শোভন সকলই বিমল’ জগতে মূর্তিমান অস্বস্তির মতো মাঝে মাঝে এসে হাজির হন ওঁরা। উৎসবের মরসুমে যখন প্রচণ্ড ভিড়ে গুজরাতের কোনও স্টেশনে ট্রেনে চাপতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান ওঁদের কয়েক জন, আমরা নিজস্বী তুলতে তুলতে সেই দৃশ্য দেখি। শত কিলোমিটার হেঁটে রক্তমাখা পায়ে কৃষকের দল যখন মুম্বই শহরের প্রান্তে হাজির হন, আমরা নির্বাক দর্শক। অতিমারির সময় ওঁরা কত শত মাইল পথ হেঁটে ফিরেছিলেন নিজের গ্রাম বা শহরে। কেউ বা মারা গিয়েছিলেন পথেই, রেললাইনের ধারে পড়েছিল তাঁদের সঙ্গে আনা রুটি এবং ফেলে যাওয়া চটি। আমাদের ওয়ার্ক ফ্রম হোম, ফেসবুক, ওয়েব সিরিজ় শোভিত জীবনের পাশে পড়েছিল সেই রুটি এবং সেই চটি।
মহাভারতে এক বিশেষ মানব অনুভূতির কথা বলা হয়েছে, অনুক্রোশ। অপর মানুষ বা প্রাণীকে উৎপীড়িত, যন্ত্রণাকাতর বা দুঃখী দেখলে সংবেদনশীল মানুষের মনে যে সমবেদনা জাগে, তাই হল অনুক্রোশ। ভারতবর্ষ কি সেই অনুভূতি সম্পূর্ণ হারাতে বসেছে? যদি তা-ই হয়, তবে প্রস্তুত হতে হবে অপমানের জন্য। যে মনুষ্যেতর জীবন যাপন করে এই মানুষরা দেশের সমস্ত চাকা সচল রেখেছেন, সমস্ত মুখে অন্ন জুগিয়ে চলেছেন, এক দিন অপমানে তাদের সবার সমান হতে হবে।
উত্তরকাশীর একচল্লিশ জন শ্রমিকের কাছে লজ্জা জ্ঞাপন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা তাই আমাদের আশু কর্তব্য।