কলঙ্ক মাথায় নিয়েও পাঁচ লক্ষ কাজ জুগিয়ে যাচ্ছে মেটিয়াবুরুজ

যে হাট আজও ‘বাজার’ হয়নি

গার্ডেনরিচ থানা থেকে আক্রা রোড ধরে হাঁটতে শুরু করলে শুধু উর্দুতে সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। এক দিকে ডক-কেন্দ্রিক অপরাধ জগৎ, অন্য দিকে জরির নকশার মতো উর্দু লিপি, বোরখা, টুপির আধিক্য। রাতে ট্যাক্সিওয়ালারা ওই দিকে যেতে চান না।

Advertisement

অভিজ্ঞান সরকার

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৯ ০০:১০
Share:

বানতলায় চর্মনগরীর উদ্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, পাঁচ লক্ষ কাজ তৈরি হবে, লগ্নি হবে আশি হাজার কোটি টাকারও বেশি। নিশ্চয়ই আনন্দসংবাদ। তবে এই কলকাতাতেই রয়েছে এমন এক শিল্প অঞ্চল, যা কাজ দেয় পাঁচ লক্ষ মানুষকে। বাৎসরিক ব্যবসার পরিমাণ অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সরকারি উদ্যোগে পাওয়া লগ্নি? শূন্য।

Advertisement

গার্ডেনরিচ থানা থেকে আক্রা রোড ধরে হাঁটতে শুরু করলে শুধু উর্দুতে সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। এক দিকে ডক-কেন্দ্রিক অপরাধ জগৎ, অন্য দিকে জরির নকশার মতো উর্দু লিপি, বোরখা, টুপির আধিক্য। রাতে ট্যাক্সিওয়ালারা ওই দিকে যেতে চান না। সন্দেহ-আশঙ্কার এই বিশেষ অঞ্চলটির নাম মেটিয়াবুরুজ। যদিও আক্রা রোডে মিনিট পনেরো হাঁটলেই বিহার-উত্তরপ্রদেশের মুসলিমদের এলাকা শেষ হয়ে বাঙালি মুসলিমদের এলাকা শুরু হয়। কিন্তু ক’জনই বা তা খেয়াল করেছেন?

১৮৫৬ সালে কলকাতায় নির্বাসিত হন অওধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। নানা ঘটনার পর যখন বুঝে যান যে লখনউতে ফেরার আর সম্ভাবনা নেই, তখন মেটিয়াবুরুজকে পাল্টাতে শুরু করেন। ঝুলন-সাজানোর মতো, যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা ঢেলে প্রতিরূপ দিতে থাকেন ছেড়ে-আসা মেহফিল নগরীর। বছরে বারো লক্ষ টাকা অনুদান দিত ব্রিটিশরা, তাতে গড়ে ওঠে সুলতানখানা, ‘মহলসরা’ বা হারেম, বাগানবাড়ি, একের পর এক মহল। আসেন গাইয়ে-বাজিয়ে, বাইজি, খানসামা, বাবুর্চি, জানোয়ারবাজ, মকানদার— কলকাতায় লখনউওয়ালাদের সংখ্যা নাকি চল্লিশ হাজার ছাড়িয়েছিল। কিছু দর্জিও এসেছিলেন। নবাবের কালে হিন্দুদের সেলাই-করা পোশাকের চল ছিল না। নবাবের মৃত্যুর পর মেটিয়াবুরুজ জৌলুস হারিয়েছে, উধাও হয়েছে বিচিত্র পেশাগুলি। টিকে গিয়েছে দর্জির পেশাটি, যা মেটিয়াবুরুজ, মহেশতলা ও আশেপাশের পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের রুটিরুজির সহায়।

Advertisement

উৎপাদনী শিল্পের পরিভাষায় এই অঞ্চলটিকে ‘ক্লাস্টার’ বলা চলে। কারখানা উৎপাদনের যে চেহারা, বড় শেডের তলায় বিভিন্ন ইউনিটের সমান্তরাল চলন, এখানে তা খুঁজলে হতাশ হতে হবে। মেটিয়াবুরুজে প্রায় দেড় হাজার ছোট ছোট গৃহভিত্তিক উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে, মহেশতলায় তিন হাজার। এখানকার পণ্য স্বল্পবিত্ত ক্রেতাদের জন্য, তাই লাভের হার থাকে সামান্য। ছোটদের পোশাক তৈরি হয় ছোট ওস্তাগর, বড় ওস্তাগরদের তত্ত্বাবধানে। ওস্তাগর অর্থাৎ দক্ষ দর্জি। বড় ওস্তাগরদের পুঁজি বেশি, ছোটদের কম। অর্ডার পেলে বা চাহিদা বুঝে এঁরা কাঁচামাল কিনে (বড়বাজার বা মেটিয়াবুরুজের বটতলা হাট থেকে) উৎপাদনী চক্রে প্রবেশ করেন। অধিকাংশ কাঁচামালের জোগানদার মারওয়াড়ি হিন্দু ব্যবসাদার, পাইকারি ক্রেতাও প্রধানত তাঁরা।

কাপড় ‘কাটিং’ করার পরের ধাপগুলি হল এমব্রয়ডারি বা প্রিন্ট, ইন্টারলক, সেলাই, ওয়াশ, কাজ সেলাই, বাট্রেক, সুতো কাটা, পাঞ্চিং, নেমপ্লেট, চেকিং, ইস্ত্রি, প্যাকিং ইত্যাদি। এমব্রয়ডারি, সেলাই ও প্যাকিংয়ের কাজ ছোট ছোট ইউনিটগুলিতে হয়, যেখানে আট-দশ জন শ্রমিক কয়েক মাসের জন্য আস্তানা গাড়েন, রান্নাবান্না করে খান। ওয়াশের কাজও প্রায় সেই রকম। চটের হাট থেকে ডাকঘরের রাস্তায় গেলে দেখা যাবে, দু’পাশে সারি সারি জিন্‌সের রং-করা প্যান্ট শুকোচ্ছে, গাছের ডালে, বাড়ির ছাদে, মাঠে, মাটিতে। বাকি সমস্ত কাজ পাড়ায় মহল্লায়, গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে বিভাজিত। একই ব্যক্তি দু’টি ধাপ করেন না, সব ধাপের জন্য আলাদা ব্যবস্থাপত্র, আলাদা যন্ত্রী। অধিকাংশই ঘরোয়া ও সরল ব্যবস্থা। সুতো কাটা, পাঞ্চিং, নেমপ্লেট লাগানোর সিংহভাগ করেন মহিলা, শিশুরা। ওস্তাগরের সঙ্গে স্থানীয় সম্পর্কের সুবাদে ওস্তাগরের ডেরা থেকে মাল নিয়ে আসেন মেয়েরা, কাজ করে ফিরিয়ে দেন। কাজের কোনও ধাপেই মেয়েরা প্রতি পিস দেড় টাকার বেশি পান না। গেরস্থালির কাজ করে অবসরে এই কাজ করে সপ্তাহে পাঁচ-সাতশো টাকা উপার্জন হয় মহিলা ও শিশুদের।

কাঁচা টাকার উপর নির্ভরশীল মেটিয়াবুরুজের বস্ত্রশিল্পকে প্রায় কোমায় পাঠিয়েছিল নোটবন্দি। জিএসটির ধাক্কা ছিল বিষফোঁড়া। এখানকার শিল্পে বৃহৎ পুঁজি বলতে কিছু নেই, পুঁজির অভাবে যন্ত্রের আধুনিকীকরণ নেই, এমনকি অর্ডার চালানোর মতো রেস্তও নেই ওস্তাগরদের। ঋণের জোগানের অভাবে স্থানীয় কিছু ক্লাব স্বল্প সুদে ব্যবসায়ীদের পুঁজি জোগায় কখনও-সখনও। সরকারি প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন করলে কেউ কিছু বলতে পারেন না।

মেটিয়াবুরুজের দর্জি-শিল্প কী ভাবে পাঁচ হাজার কোটির ব্যবসায় পরিণত হল তার কোনও প্রামাণ্য ইতিহাস লেখা হয়নি। এলাকায় কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় সজ্জন জব্বর সাহেব এক বাজারের কাঠামো শুরু করেন ১৯৮৬ সালে, হাওড়ার মঙ্গলাহাটের দূরত্বের কারণে। সেটাই ‘জব্বর হাট’ নামে পরিচিত।

অনেকে জানেন না, মেটিয়াবুরুজে উৎপন্ন পণ্য ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রফতানি হয়। এমনকি শ্রীলঙ্কা, আরব দেশেও পৌঁছয়। কাঁচামাল আর প্যাকেটবন্দি জামাকাপড়, দুটোরই বিকিকিনির কেন্দ্রগুলিকে ‘হাট’ বলা হয়। উৎপাদন ব্যবস্থার অনাধুনিকতার জন্যই হয়তো এলাকার মানুষের চিন্তায়, কথায়, মেটিয়াবুরুজ এখনও ‘হাট’ থেকে ‘বাজার’ হয়ে ওঠেনি। হাওড়ার মঙ্গলাহাট মঙ্গলবারই বসে। মেটিয়াবুরুজের বটতলার বিরাট হাট গমগম করে শনি-রবিবার।

ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটের শ্রমিকদের সর্বাধিক মজুরি মাসিক আট হাজারের বেশি নয়। ইউনিয়নের বালাই নেই, শ্রম আইনের চিহ্ন নেই। কুচি কুচি করে ছড়ানো কুটিরশিল্পের মতো ব্যবস্থা। কারখানা-ভিত্তিক ব্যবস্থায় শ্রমিক চেতনার বিকাশ যে ভাবে হয়, এখানে তার সম্ভাবনা কম। শ্রমিকের সঙ্গে নিয়োগকারীর অর্থনৈতিক দূরত্বও কম — ছোট ওস্তাগরের উপার্জন মাসে পনেরো-কুড়ি হাজার টাকার বেশি নয়। হাটে ছোট ওস্তাগররা জামাকাপড় বেচেন ছোট একটি ঘুপচি খুঁজে নিয়ে।

বহু জামাপ্যান্ট তৈরির ইউনিটে নাবালকদের নিয়োগ করা হয়। মাসিক চার হাজার টাকায় গরিব পরিবারের অমৃতের সন্তানরা কৈশোর কাটিয়ে দেয় চিন থেকে আসা বিরাট লম্বা এমব্রয়ডারি মেশিনের সুতোর জট ছাড়াতে ছাড়াতে। ‘পেটে-ভাতে’ বলে একটি ব্যবস্থা আছে, কারখানায় আরও ছোট শিশুদের শুধুমাত্র খাবারের বিনিময়ে কাজ।

মেটিয়াবুরুজে কান পাতলেই শোনা যায়, এ এক এমন শিল্প যেখানে সময়ের সঙ্গে মজুরি কমেছে। বাংলাদেশ ও চিনের আরও সস্তা পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে এখানকার বস্ত্রশিল্পে একটি মৌলিক পরিবর্তন এসেছে— এখন কাজের একটা বড় অংশ ‘আউটসোর্স’ হয় গ্রামে। মেদিনীপুরের বিভিন্ন অঞ্চল, বারুইপুর, ক্যানিং, বসিরহাট, বর্ধমান, হাওড়ার মুসলমান-অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপ, এমনকি পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়াটি‌ও সম্পূর্ণ হয়। চাষের সময় বাদ দিয়ে গ্রামের মুসলিম চাষি আরও স্বল্প মজুরিতে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। মেটিয়াবুরুজের ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল আর নকশা পাঠিয়ে দেন এই সব অঞ্চলে, নির্দিষ্ট সময়ে ডেলিভারি পেয়ে যান।

মেটিয়াবুরুজের বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ৯০-৯৫ শতাংশ মানুষ মুসলমান। সন্তোষপুরের এক প্রাজ্ঞ মানুষ বলছিলেন, হজরত মহম্মদ বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করতেন, তাই মুসলিম সম্প্রদায় গর্বের সঙ্গে এই পেশাকে আঁকড়ে ধরেছে। সম্প্রদায়ের মানুষ মালিক, সম্প্রদায়ের মানুষ শ্রমিক। শোষণের বিরোধাভাস ধর্মীয় একাত্মতায় চাপা পড়ে।

এই ভাবেই মেটিয়াবুরুজ ক্লাস্টার চলেছে রাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়াই। বিন্দু বিন্দু পুঁজি দিয়ে চলছে আদিম এক ব্যবস্থা, যেখানে বিকেন্দ্রিত, সামন্ততান্ত্রিক গেরস্থালি-নির্ভর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত পণ্য চলে আসছে বাজারে। লক্ষ লক্ষ মানুষের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থাও হচ্ছে অবশ্য। কিন্তু এই শিল্পাঞ্চল নিয়ে চর্চা-আলোচনা কোথাও কিছু নেই। বামফ্রন্টের শিল্পায়নের ঢক্কানিনাদের সময়ে উন্নততর ‘মেটিয়াবুরুজ’ তৈরি করার কোনও কথা শোনা যায়নি, তৃণমূল আমলে ‘এগিয়ে বাংলা’ স্লোগান উঠেছে, কিন্তু মেটিয়াবুরুজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও চেষ্টা দেখা যায়নি। মেটিয়াবুরুজ শুধু কুখ্যাতি পেয়েছে পাকিস্তানের ‘ক্ষুদ্র সংস্করণ’ বদনামে— সিনেমায়, গল্পকথায়, সমাজমাধ্যমে, হিন্দুসমাজের প্রবাদে। যদিও বাবরি মসজিদের সময়ে কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া দ্বন্দ্বের নজির নেই এখানে। স্থানীয় ব্যবসায়ী শামসুল বলছিলেন সাম্প্রদায়িক সমস্যা হলে ব্যবসা চলবে না, মারওয়াড়িরাও এ দিকে ঢুকবে না। তবু কলঙ্ক মাথায় নিয়ে মেটিয়াবুরুজ জুগিয়ে যাচ্ছে সব ধর্মের পুজো-পার্বণে গরিব-মধ্যবিত্তের নতুন জামা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement