এই উচ্ছ্বাস-বৃত্তের বাইরে যারা পড়ে থাকল?

সেই মেয়েরা আসলে কী করে? কেমন করে দিন কাটায়? জানা যাচ্ছে, তাদের এক বা দু’জন করে গৃহশিক্ষক আছেন। তবে কি তারা সেখানেও পড়ছে না? লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামনতুন সকাল। ফলাফল এসে গিয়েছে। মেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে। আনন্দের শেষ নেই! কিন্তু এর পরে পড়ে কী হবে? চাকরি? সে তো পাওয়া কঠিন! তা হলে বিয়ে? অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ। আর ভাল পাত্র না পেলেও ক্ষতি নেই! কিন্তু পড়াশোনা করলে পণ কম লাগবে তো!

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৯ ০১:৫৯
Share:

‘‘Success is no guarantee and even the best can fail.’’

Advertisement

ফেল কথাটার মধ্যে বৈষম্য আছে। অলিখিত বিচ্ছিন্নতার সুর আছে। সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার পীড়ন আছে। চাপা অন্ধকারের প্রতিফলন আছে। পরীক্ষা ব্যবস্থা দোষের না হলে ফেলও দোষের নয়। কিন্তু ফেলের সঙ্গে চিহ্নিতকরণ খারাপ। ‘ও মা, ১২ টা ফেল’ বলে ১২ জন কিশোরীর বুদ্ধি ও সুস্থতাকে প্রশ্ন করা খারাপ। ফেলের সঙ্গে আছে কষ্ট। অভিভাবক ও সন্তান দু’পক্ষকেই ছুঁয়ে যায় সেই অযৌক্তিক আঘাত। অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীরাও মনে করে, ফেল মানে ‘পরিবারের লজ্জা’, ‘মুখ লুকিয়ে বেড়ানো’! কিন্তু বড়মাপের মিথ্যা এই অনুভব। তা ছুড়ে ফেলা প্রয়োজন। কেননা ফেল আর একটি ফেলের জন্ম দেয়। তাই ফেল কথাটার সঙ্গে জুড়ে থাকা ভাবনার সমাপ্তি দরকার।

নতুন সকাল। ফলাফল এসে গিয়েছে। মেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে। আনন্দের শেষ নেই! কিন্তু এর পরে পড়ে কী হবে? চাকরি? সে তো পাওয়া কঠিন! তা হলে বিয়ে? অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ। আর ভাল পাত্র না পেলেও ক্ষতি নেই! কিন্তু পড়াশোনা করলে পণ কম লাগবে তো! তা না হয় আর কিছু দূর পড়ুক! দেখতে দেখতে পাত্র ঠিকই জুটে যাবে। নইলে পরে দেখা যাবে। মেয়ে নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক ভাবনা মুখ্যত এই।

Advertisement

আর যে মেয়েটি পাশ করতে পারল না? তার পড়া হয়তো আর এগোবে না। খুব তাড়াতাড়ি শুরু হবে গ্রাম ছাড়ার পালা। বিয়ে করে অন্যত্র শুরু হবে নিজের ভাগ্যপরীক্ষা। পাশের গণ্ডী না পেরিয়ে এমন পরিণতি জেলার নানা প্রান্তের মেয়েদের। বছরের পর বছর ধরে কমতে থাকা পাশের হার দেখে ক্লান্তি নেই। ‘সব ঠিক হয়ে যাবে দ্রুত’— এই আশ্বাস পাথেয়। সব নাকি ‘ঢেলে সাজানো চলছে’। কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, সব প্রকল্পেই অভূতপূর্ব সাড়া। ‘মেয়েরা এগিয়ে’ স্লোগানে নাকি নবাবের দেশেও হাওয়াবদল হচ্ছে! কিন্তু সব প্রক্রিয়াকে প্রায় ভুল প্রমাণ করে সেই মেয়েদের পাশের হার ক্রমশ কমছে। মানে, সোজা কথায় মেয়েরা তুলনামূলক ভাবে বেশি ফেল করছে।

মেয়েরা কেন পড়তে পারছে না? জবাব আসছে, ‘‘মেয়েরা ভাল ফল করছে তো!’’ শীর্ষে থাকছে দুই- এক জন পড়ুয়া, এ কথা সত্য। অনেকে ভালও ফল করছে। মার্কশিট হাতে বন্ধুদের সঙ্গে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে তারা। স্কুলে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি গেলে ক্যামেরাবন্দি হচ্ছে উচ্ছ্বসিত মুখ। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস-বৃত্তের বাইরেও পড়ে থাকছে পিছিয়ে পড়া অনেক মুখ। সেই মেয়েরা আসলে কী করে? কেমন করে দিন কাটায়? বাড়িতে খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, তাদের এক বা দু’জন করে গৃহশিক্ষক আছেন। তবে কি তারা সেখানেও পড়ছে না? শহরের দিকে অভিযোগ, ‘মেয়েরা টিভি দেখছে। মোবাইলে সময় নষ্ট করছে।’ গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা ‘বিড়ি বাঁধছে’ কিংবা ‘মাকে ঘরের কাজে’ সাহায্য করছে। বাকি সময় কেন পড়ছে না? এ কি অনীহা, অনিচ্ছা নাকি অমনোযোগিতা? পাশ করতে না পারা মনীশা বলছে, ‘পড়া মনে থাকে না!’

আসলে মানুষ যে ভাবে শেখে ঠিক সে ভাবে মস্তিষ্কে ধরে রাখতে পারে না। এর অন্যতম কারণ মানসিক চাপ। ড: রবার্ট ফিনকেল ‘মেমোরি বুস্টার’ এ এই কথার উল্লেখ করেন। হাসি, গান, বিনোদন মানসিক চাপ প্রতিরোধক। কিন্তু মেয়েদের সুযোগ কতটা? আর মানসিক চাপরোধক হিসেবে দরকার পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম, সুষম খাদ্য, বেশি পুষ্টিকর খাবার। এই প্রয়োজন সত্যিই কতটা মেটে? ভুলে যাওয়া পড়া সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করে নিলে মনে রাখার সুবিধা হয়। মেয়েদের সামনে সেখানেও বড় একটা সুযোগ নেই। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। ফলে তৈরি হয় মানসিক চাপ। এই অবাঞ্ছিত চাপের কারণে মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক বস্তু বা নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য নষ্ট হয়। অন্তঃক্ষরা বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হরমোনের ঘাটতি বাড়তি হয়। হৃদযন্ত্রের সংকোচন-প্রসারণের হার পরিবর্তিত হয়। শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় তারা তুলনামূলক ভাবে বেশি ভোগে। যার একটা স্থির ও স্থায়ী প্রভাব পড়াশোনায় পড়ে।

অন্য দিকে সাবিনা বলছে, ‘‘পড়ার সময় পাই না। বাড়িতে ছোটো ভাই রয়েছে। মায়ের অপারেশন হয়েছে।’’ আসলে পড়াশোনা একান্তই সময়, আগ্রহ এবং আত্মবিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। এই সময় না পাওয়ার ব্যাপারটি গ্রামবাংলায় ভীষণ ভাবে সত্যি। পরিবারের মাথা কেরলে কাজে গিয়েছেন। শাসনের কেউ নেই। এ দিকে মা অসুস্থ। রান্না করা ও বাজার যাওয়া সবটাই সাবিনার মাথায়। জানা গেল, সুস্থ থাকলে সাবিনার মা বিড়ি বাঁধেন। সাবিনারও মায়ের সঙ্গে অভ্যাস হয়ে গেছে। সে বিড়ি বাঁধলে সংসারে আরও দু’পয়সা আয় বাড়ে।

রুবিনার একটাই কষ্ট। সামনে ইদ। ভাল জামা হবে না বেচারার! ফেল করেছে বলে সবটাই মাটি। ফেল কেন? তার বক্তব্য, ‘‘জানো, যে ছেলেরা লেখাপড়ায় আমারই মতো তারাও পাশ করেছে। আসলে ছেলেরা টুকছিল খুব। আমি পারিনি।’’

রুবিনা বলে, ‘‘ওদের সম্মানের ভয় নেই। বাধা দিলে মাস্টারকে ওরা মারতেও পারবে। আমাদের ঘরে খুব কড়াকড়ি ছিল। কেউ বলতেও আসেনি। গার্ড কথা বলতেও দেয়নি।’’ কিন্তু কথা বলা বা নকল করা তো নিষিদ্ধ, বেআইনি? রুবিনার কথায়, ‘‘সে তো জানিই। কিন্তু ওরা সে সব না মেনেই পাশ করে গেল। আর আমি নিয়ম মেনে সেই ফেলই হলাম।’’ এটা আগেও প্রমাণিত যে, সম-মানের হওয়া সত্ত্বেও একদল টুকলি করার দক্ষতা ও সাহসের গুণে পাশ করে গিয়েছে। সেই সাহস মেয়েরা সময় মতো দেখাতে পারে না। প্রকৃতিগত ভাবেই তারা কম অ্যাগ্রেসিভ ও অবাধ্যতায় পিছিয়ে।

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement