সম্পাদকীয় ২

বুলা বারিকের মৃত্যু

পশ্চিমবঙ্গে প্রসূতিমৃত্যুর হার জাতীয় গড় অপেক্ষা কম, ইহা শুনিতে ভাল। কিন্তু যে শিশুটি জন্মিয়াই মাতৃহারা হইল, যে পরিবার বধূ বা কন্যাকে হারাইল, তাহাদের ইহাতে সান্ত্বনা মিলিবে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১৫
Share:

ঘটি না ডুবিলেও যেমন তালপুকুর, তেমনই দশা পশ্চিমবঙ্গের ‘সুপার স্পেশালিটি’ হাসপাতালের। পাত্রসায়রের এক প্রসূতির যে ভাবে মৃত্যু হইয়াছে বিষ্ণুপুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও তেমন হইবার কথা নহে। বুলা বারিকের মৃত্যুর কারণ কতখানি অ-চিকিৎসা, আর কতখানি অপচিকিৎসা, সে প্রশ্নটি জরুরি। চিকিৎসার অভাব যে ঘটিয়াছে, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে তাহার ইঙ্গিত স্পষ্ট। শিশু ভূমিষ্ঠ হইতে চলিয়াছে, তখনও চিকিৎসকের দেখা মেলে নাই। উপরন্তু নার্স ও আয়ারা নাকি প্রসূতির পেটে হাঁটুর চাপ দিয়া প্রসব ত্বরান্বিত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। এই সংবাদ ভয়ঙ্কর। ইহা কি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ধাত্রীবিদ্যা? কেবল নিয়মমাফিক বিভাগীয় তদন্ত নহে, বিশেষজ্ঞ দল দ্বারা ইহার স্বাধীন তদন্ত প্রয়োজন। প্রসূতির ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক-নার্সদের শাস্তিবিধানের জন্য নহে, যদিও আত্মীয়রা সে দাবি করিতেই পারেন। তদন্তের প্রয়োজন একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতে— সরকারি হাসপাতালে প্রসব কতখানি নিরাপদ? ইহার উত্তর কিন্তু জনসমক্ষে পেশ করে নাই রাজ্য সরকার। প্রসব সুরক্ষিত করিতে প্রসূতিকে হাসপাতালে আনিবার জন্যই প্রচার করিয়াছে। প্রসূতিমৃত্যু প্রতিরোধ করিতে এখন প্রতিটি মৃত্যুর বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হইয়া থাকে। তাহাতে বার বার স্পষ্ট হইয়াছে যে, যে-সকল মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব হইত, সেগুলিও এড়ানো যায় না। একটি কারণ যথেষ্ট চিকিৎসক, বিশেষত অ্যানেস্থেশিয়া বিশেষজ্ঞ এবং প্রশিক্ষিত নার্সের অভাব। দ্বিতীয় কারণ, নিরাপদ প্রসবের রূপরেখাটি যথাযথ ভাবে পালন না করিবার প্রবণতা। তাহা কখনও চিকিৎসক ও সহায়ক কর্মীদের দায়বদ্ধতার অভাব, কখনও কাজের চাপ, কখনও প্রশিক্ষণে ত্রুটি, এমন নানা কারণে ঘটিতেছে।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গে প্রসূতিমৃত্যুর হার জাতীয় গড় অপেক্ষা কম, ইহা শুনিতে ভাল। কিন্তু যে শিশুটি জন্মিয়াই মাতৃহারা হইল, যে পরিবার বধূ বা কন্যাকে হারাইল, তাহাদের ইহাতে সান্ত্বনা মিলিবে না। হাসপাতালে আনিয়াও বিনা পরিষেবায় স্বজনের যন্ত্রণাকাতর মৃত্যু দেখিলে কে স্থির থাকিতে পারে? প্রশ্ন উঠিতে বাধ্য, সরকার প্রসূতিকে হাসপাতালে আনিবার নির্দেশ দিয়াছে রাজ্যবাসীকে, কিন্তু হাসপাতালকে প্রসূতির উপযুক্ত করিয়াছে কি? ২০০৮-২০১৬— এই সময়ে হাসপাতালে প্রসবের হার দ্বিগুণ হইয়াছে ভারতে। বর্তমানে প্রায় আশি শতাংশ প্রসব হাসপাতালে হইতেছে। প্রসূতিমৃত্যুর হারও কমিয়াছে, তবে নির্ধারিত আন্তর্জাতিক লক্ষ্যে ভারত পৌঁছাইয়াছে কি না, সে বিষয়ে দ্বিমত রহিয়াছে। কিন্তু এ বিষয়ে বিতর্ক নাই যে, ‘জননী সুরক্ষা যোজনা’র আর্থিক অনুদান দিয়া, আশাকর্মীদের নিয়োগ করিয়া, প্রসূতিদের হাসপাতালে আনিলেই কাজ ফুরায় না। সরকারি হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে থাকিয়াও মায়েরা যথাযথ পরিষেবা না পাইয়া মরিতেছে। এই কারণে দরিদ্র পরিবারও ঘটিবাটি বেচিয়া বেসরকারি হাসপাতালে প্রসূতিকে ভর্তি করাইতে চাহে। সর্বপ্রথম প্রয়োজন স্বচ্ছতার। কেন হাসপাতালে প্রসূতিমৃত্যুতে উন্নতি হয় নাই, কোন কোন কারণে এখনও বুলা বারিকদের মরিতে হইতেছে, তাহা জানাইতে হইবে সরকারকে। বুঝাইতে হইবে, ‘সুপার স্পেশালিটি’ নামক মনোহর তকমার অর্থ কী? প্রতারণা বন্ধ হউক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement