Breathing Problems

সম্পাদক সমীপেষু: নিঃশ্বাসের অধিকার

যে কোনও নির্মাণকার্যে পাথর প্রয়োজন। তাই বিশ্ব জুড়ে এই শ্রমটির ভূমিকা অপরিসীম হলেও প্রশাসনের লক্ষ্য থাকুক পাথর শ্রমিকের নিরাপত্তা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২২ ০৫:০৩
Share:

সোমা মুখোপাধ্যায়ের তিন কিস্তির প্রতিবেদন (‘পাথর ভাঙা বিষ’, ২৫-৪, ২৬-৪, ২৭-৪) পড়ে সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত গরিব, অসহায়, শ্বাসকষ্টে কাতর শ্রমিকদের যন্ত্রণা উপলব্ধি করলাম। মনে হল, আমরা যাঁরা বিভিন্ন কারখানায় (বিশেষত বিদ্যুৎ, ইস্পাত, সিমেন্ট, খনি ইত্যাদি শিল্পে) যুক্ত, তাঁদের সকলের উচিত কর্মস্থলে শ্রমিক-কর্মচারীদের পেশাগত রোগগুলি (অকুপেশনাল ডিজ়িজ়) সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা, এবং রোগের সচেতনতা সংক্রান্ত নিয়মকে মান্যতা দেওয়া।

Advertisement

১৯৩২ সালে জোহানেসবার্গ সম্মেলনে সিলিকোসিস রোগটিকে ‘পেশাগত রোগ’ আখ্যা দেওয়া হয়, ভারতে ১৯৫১ সালে শ্রম আইনে তাকে ‘নোটিফায়েড ডিজ়িজ়’ বলে চিহ্নিত করা হয়। অথচ, এখনও এ দেশে সিলিকোসিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অবৈধ খাদানের শ্রমিকদের, এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের যোগ করলে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হলেও আশ্চর্য হব না। কারণ, পাথর-পেষণকারী শ্রমিকদের ৫৫ শতাংশ ভুগছেন এই পেশাগত মারণব্যাধিতে।

প্রতিবেদক উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁর গোয়ালদহ (২০১১ সালে যেখানে ২৮ জনের মৃত্যু প্রকাশিত) এবং বীরভূমের (জেলায় প্রায় ১০০০ পাথর ভাঙা ইউনিট) হাবরাপাহাড়ি গ্রাম-সহ পাশাপাশি গ্রামের অসুস্থ শ্রমিকদের মর্মান্তিক বাস্তব চিত্র প্রকাশ করেছেন। তবে পাথর শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ চোখে পড়ে— তা হল শব্দদূষণে শ্রবণশক্তি হারানো, অর্থাৎ বধিরতা।

Advertisement

যে কোনও নির্মাণকার্যে পাথর প্রয়োজন। তাই বিশ্ব জুড়ে এই শ্রমটির ভূমিকা অপরিসীম হলেও প্রশাসনের লক্ষ্য থাকুক পাথর শ্রমিকের নিরাপত্তা। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাওয়ার দাবি কি অন্যায়? না কি বড্ড বেশি চাওয়া? পাথর শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসমস্যা নিরসনে ও সচেতনতার লক্ষ্যে সরকারের মিষ্টি প্রতিশ্রুতি শেষ কথা নয়। এর বাস্তব প্রয়োগ চাই।

সুব্রত পাল
শালবনি, বাঁকুড়া

উপায় স্বচ্ছতা
রাজ্যে সিলিকোসিস আক্রান্তদের নিয়ে সোমা মুখোপাধ্যায়ের প্রতিবেদন পাথর ভাঙার কারখানায় শ্রমিকদের অমানবিক পরিস্থিতির এক জ্বলন্ত প্রতিফলন। শিল্পের প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কিন্তু গরিব মানুষের দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির কারবারিরা শ্রমিকদের ন্যূনতম সুরক্ষার ব্যবস্থা করছে না। তাঁদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। রাজ্য সরকার সিলিকোসিস আক্রান্তদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুনর্বাসনের জন্য যে নীতি গ্রহণ করেছে, তা নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়। কিন্তু তা শুধু খাতায়-কলমে সীমাবদ্ধ না থেকে, নিয়মিত ভাবে যেন প্রয়োগ করা হয়, তার দিকে লক্ষ রাখতে হবে। এই সমস্ত পাথর-ভাঙা কারখানা, বাজির কারখানা প্রভৃতিতে যেন মালিকের পক্ষ থেকে সুরক্ষাবিধি ভঙ্গের ঘটনা না ঘটে, সবার আগে তা নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য দেখতে হবে, যাতে প্রতিটি চালু কারখানা আইনসম্মত হয়, অবৈধ খাদান-কারখানা যেন চলতে না পারে। তবেই চিহ্নিত হবেন প্রতিটি কর্মরত শ্রমিক, এবং তাঁদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা যাবে।

রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে রাজ্য সরকারকে, কোনও বেআইনি কারখানাকে ছাড় দেওয়া চলবে না। তেমনই, এই শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিয়েও যথার্থ পরিসংখ্যান সামনে আনতে হবে। তাতে সরকারের ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল হবে। এক জন শ্রমিকও অসুস্থতাজনিত কারণে যেন অকালে ঝরে না যান, তা দেখার দায়িত্ব সরকারের। সেই সঙ্গে, প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরও।

অশোক দাশ
রিষড়া, হুগলি

মর্মস্পর্শী
সোমা মুখোপাধ্যায়ের তিনটি প্রতিবেদন অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকতার এক মর্মস্পর্শী দলিল। বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লক অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত পাথর ভাঙার কারখানায় নিযুক্ত শক্তসমর্থ যুবকরা ধুলোর বিষে সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে কী ভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করেন, বা জীবন্মৃত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেন, সেই পরিবারের চিত্র প্রতিবেদক নাগরিক সমাজের কাছে তুলে ধরেছেন। সম্প্রতি রাজ্যে সিলিকোসিস রোগীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে সরকারি নীতি ঘোষিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার সুফল ওই রোগীদের ও তাঁদের পরিবারের কাছে অধরাই থেকে গিয়েছে। উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও তাঁদের কাছে পৌঁছয় না। ভোট বাক্সে তাঁদের প্রভাব সামান্য, তাই এঁদের নিয়ে ভাবার যেন কোনও প্রয়োজন নেই শাসক দলের। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, মাস মাইনের সরকারি আধিকারিক (লেবার অফিসার, বিডিও, এসডিও, ডিএম) এই শ্রমিকদের বিশেষ খোঁজখবর রাখেন না। এঁদের অধিকারের দাবি তুলে সরকারকে বিড়ম্বনায় ফেলতে চান না কেউ। অগণিত বেআইনি কারখানা ঠেকানোর জন্য নজরদারি নেই। ধুলো আটকানোর জন্য ‘ফগার’ মেশিনের কোনও ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। মালিকের দায়বদ্ধতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেন না। সদিচ্ছার অভাব, সঙ্গে লোকবলেরও অভাব। রাজ্যে মেডিক্যাল ইনস্পেক্টর অব ফ্যাকট্রিজ়-এর ন’টি পদের মধ্যে আটটিই শূন্য। ‘মে দিবস’ এক বাৎসরিক উৎসবের মতো যথারীতি পালন হয়।

জহর সাহা
কলকাতা-৫৫

উপেক্ষাই নিয়তি?
‘অবহেলার শ্রম’ (১-৫) সম্পাদকীয় নিবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ বহু মানুষের মনে এই প্রত্যয় জাগিয়েছিলেন যে, শিল্পোদ্যোগীরা ব্যক্তিগত লাভের দিকে দৃষ্টি রেখে সমাজে এক পরিবর্তনের সুযোগ এনে দিতে সক্ষম। কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগের ভূমিকা অনেক সময়েই সমাজকল্যাণের পরিপন্থী হয়েছে। সেই সময়ে সমাজের অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্ত করতে কল্যাণকামী রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। মার্ক্স কিংবা গান্ধী রাষ্ট্রের ভূমিকাকে প্রাধান্য না দিয়েও অন্য সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। মার্ক্স আশা করেছিলেন, শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠনই পারবে আর্থিক বিকাশের পথ প্রশস্ত করতে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর গান্ধী আর্থিক বিকাশকে জীবনচর্যার প্রধান লক্ষ্য বলেই মনে করতেন না। তাঁর মতে, জীবনযাত্রার পক্ষে অত্যাবশ্যক বস্তুগুলির জন্য স্বয়ম্ভর স্থানীয় গোষ্ঠীগুলিই যথাযথ কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। শক্তিমান রাষ্ট্রকে ‘বাহুল্য’ বলে বর্জন করাই ছিল তাঁর মতে যুক্তিযুক্ত।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় রাষ্ট্র বাজারের পথ ধরে এগিয়ে যেতে আগ্রহী, কিন্তু একটু ভাল করে নজর দিলে বাজারের আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ স্পষ্ট হয়। উদারীকরণ এবং বিলগ্নিকরণের হাত ধরে রাষ্ট্র উন্নয়নের ধারাটিকে ব্যক্তিগত শিল্পোদ্যোগীদের হাতেই ন্যস্ত করেছে। কিন্তু শ্রমিকদের উন্নত মানের জীবনযাপনের ব্যবস্থা করতে তাঁরা ব্যর্থ। এ ছাড়াও অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির জগৎ শ্রমিকদের কর্মনিযুক্তির আশাকে আরও প্রতিহত করেছে। সম্প্রতি পরিযায়ীদের দুর্দশা দেখিয়েছে, এ দেশে শ্রমিকস্বার্থ সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা কতটা মেকি। তা ছাড়া প্রাদেশিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিযায়ী শ্রমিকরা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ‘শত্রু’-তে পরিণত।

দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড লক্ষ লক্ষ দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক। কিন্তু তাঁদের শ্রম যে রাষ্ট্রের নিকট নিছক অবহেলার বস্তু, তা আমাদের দেখিয়েছে সাম্প্রতিক অতীত। মানবসম্পদের এমন অবহেলা উন্নত রাষ্ট্র গঠনের অন্তরায়। রাজনীতিও এই শ্রমিকদের দায় স্বীকারে নারাজ। যে দেশে শিল্পের বাজারে কেবলই মন্দা চলে, যেখানে শ্রমের চাহিদার তুলনায় জোগান অত্যধিক, সেখানে শ্রমের অধিকার যে ন্যূনতম শর্তগুলিকেও মান্যতা দেবে না তা বলা বাহুল্য। তাই শ্রমের অবহেলা, দেশ জুড়ে মানবসম্পদের অবমূল্যায়নই দেশের ভবিষ্যৎ।
সঞ্জয় রায়

দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement