সদ্যসমাপ্ত কর্নাটক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। —ফাইল চিত্র।
সুমিত মিত্রের ‘বিদ্বেষের পরাজয়’ (১৭-৫) শীর্ষক প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। সদ্যসমাপ্ত কর্নাটক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। মাত্র দু’বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হিন্দুত্বের কারবারিদের যোগ্য জবাব দিয়ে প্রমাণ করেছিল, এই দেশে নির্দিষ্ট কোনও জাতিগোষ্ঠীর নামে জনাদেশ চাইলে বহুত্ববাদে আরও বেশি করে আস্থা জানাবেন সাধারণ মানুষ। উগ্র হিন্দুত্ববাদের সুরে তার বেঁধে কর্নাটক রাজ্যে প্রচারে শামিল হয়েছিলেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব, ঠিক যেমন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও সর্বশক্তি নিয়োগে খামতি ছিল না। প্রমাণিত হয়েছে যে, সমাজের একটি নির্দিষ্ট স্তরের মানুষ বিজেপিশাসিত রাজ্যটিতে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট লাভবান হয়েছেন। ক্ষমতার দম্ভে বলিয়ান পূর্বতন সরকার তাই অনুমান করতে পারেনি যে, দুধের উপর জমা হওয়া ক্ষীরপ্রত্যাশী উচ্চবিত্ত মানুষের বাইরেও অসংখ্য মানুষ রয়েছেন, যাঁরা এক নিমেষে বদলে দিতে পারেন রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কর্নাটক রাজ্যের ভোট প্রচারে বলেছিলেন, “বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে তারা ভগবান হনুমানজিকে জেলে পুরবে।” এটা যে কতটা মিথ্যা, তা হয়তো বিচক্ষণ তিনি জানতেন। তবুও দেশের বিভিন্ন স্থানে হিংসাশ্রয়ী ঘটনায় নাম জড়ানো বজরং দলের হয়েই তিনি ব্যাটিং করতে নেমে পড়লেন। কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহার ছিল খুব স্পষ্ট। সেখানে শুধু বজরং দল নয়, পিপলস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া দলটিকেও রাজ্যে বেআইনি বলে ঘোষণা করার অঙ্গীকার করেছিল। তাই ক্রমাগত ব্যবহারে ভোঁতা বা অকেজো হয়ে আসা হিন্দুত্বের তাস খেলেও শেষ হাসি হাসতে পারেনি বিজেপি।
ভারত সাংবিধানিক দিক থেকে এখনও পর্যন্ত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সাধারণ মানুষের চাহিদাগুলি এই দেশে কখনও ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয়। তাই মন্দির-মসজিদের রাজনীতি সাময়িক ফলদায়ক হলেও বহুত্ববাদ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। আপাতত হিন্দি বলয়গুলি বাদ দিলে বিজেপি দেশের কোনও রাজ্যেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। অতএব ২০১৯-এর ৩০৩ লোকসভা আসনের কাছে পৌঁছতে গেলে শুধু হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান এই জাতিচেতনায় আবদ্ধ থাকলে সাফল্যে বাধা আসবেই।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
কংগ্রেসের পক্ষে
‘বিদ্বেষের পরাজয়’ শীর্ষক প্রবন্ধে যথার্থই বলা হয়েছে, বিজেপির মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক বিশ্বাসকে সম্প্রতি কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভয়ঙ্কর ভাবে টলিয়ে দিয়েছে। বিধানসভা বা লোকসভার ভোটের আগে সাধারণত প্রচারের মুখ্য বিষয় ওঠে, বিগত বছরে ক্ষমতাসীন সরকার মানুষকে কতটা সুশাসন দিতে পেরেছে এবং দুর্নীতির থেকে কতটাই বা দূরত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, বিজেপির যে কোনও নির্বাচনে জেতার মুখ্য পথই হচ্ছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, যেখানে মানুষের দাবি-দাওয়ার ভূমিকা হয়ে ওঠে গৌণ। মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা শোনার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বেশি ব্যস্ত থাকেন, বিরোধীরা তাঁকে কতটা গালি দিয়েছেন সেই নিয়ে কপট চোখের জল ফেলতে। অবশ্যই হিন্দি বলয়ে এই ধরনের প্রচার দলকে অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনী বৈতরণি পার করতে সাহায্য করেছে। কিন্তু জাত্যভিমান ও স্থানীয় সুখ-সুবিধাকেই প্রাধান্য দিয়ে হিন্দি বলয়ের রাজনীতি থেকে সব সময় দূরে থাকাই পছন্দ করে দক্ষিণের রাজ্যগুলো। তাই বিজেপির বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ এবং বিভেদমূলক প্রচার কর্নাটকের ভোটে কংগ্রেসেরই পক্ষে যায়। নির্বাচনী প্রচারের একটা মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে, গুজরাতের দুগ্ধজাত সংস্থা আমুলকে অনলাইনে ব্যবসার সুযোগ করে দিলে, কর্নাটকের দুগ্ধজাত সংস্থা নন্দিনীর বিক্রি কমে গিয়ে বেকার হয়ে যেতে পারেন এর সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ। এখানে প্রাধান্য পায় রাজ্যের অধিকার। প্রবন্ধে সঠিক ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাহুল গান্ধী ভারত জোড়ো যাত্রার মাধ্যমে কংগ্রেসের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব কমিয়ে এনেছেন। সঙ্গে যোগ হয়েছে দলের স্থানীয় মজবুত সংগঠন, যা কর্নাটকের নির্বাচনে প্রভাবিত করেছে ভোটারদের। তাই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জোড়াতালি দেওয়া পরস্পরবিরোধী জোটের পক্ষে মানুষের আস্থা অর্জন করা খুবই কঠিন। প্রয়োজন কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ভোট পূর্ববর্তী জোট, যা একমাত্র টলাতে পারে বিজেপিকে। তবে এর জন্য ক্ষমতাসীন রাজ্যগুলোতে প্রতিষ্ঠা করা উচিত কংগ্রেসের বিভেদহীন সুশাসন। নরেন্দ্র মোদীর কথায় যেটা ‘রেউড়ি’ রাজনীতি, তার থেকেও যতটা সম্ভব দূরে থাকা এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। ভারতের ইতিহাসের ধারা বজায় রাখতে এই অঙ্গীকারই মানুষ আশা করে, যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে সকলের সমান অধিকার।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
রাজনীতির শিক্ষা
সুমিত মিত্র তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য কর্নাটক রেখে গেল অঢেল শিক্ষা। নিঃসন্দেহে, তাই। বোম্মাই মন্ত্রিসভার নির্লজ্জ দুর্নীতির কাহিনি যখন সারা দেশে পল্লবিত, প্রধানমন্ত্রী তখন প্রতিটি জনসভায় ৪০ বছর আগে করা গান্ধী পরিবারের মন্তব্য টেনে প্রমাণ করতে চাইলেন কংগ্রেস আরও দুর্নীতিপরায়ণ। বোঝার চেষ্টা করলেন না, বোম্মাই সরকারের দুর্নীতি ও অপদার্থতা ঢাকতে গিয়ে তিনি নিজেকেই ছোট করছেন। বিজেপি তার পছন্দসই পাঠ্যসূচি অনুযায়ী ধরে নিয়েছিল মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, অভাব, ও হাহাকারক্লিষ্ট মানুষের একমাত্র প্রলেপ ধর্ম। ভেবেছিল, আর্যাবর্তের জড়িবুটি বিন্ধ্য পর্বতমালার দক্ষিণেও কাজ দেবে। ভুলে গিয়েছিল, জনবহুল রাজ্য কর্নাটকে মানুষের কাছে ‘জয় বজরংবলী’ ধ্বনির তুলনায় গ্যাস সিলিন্ডারের দাম অধিক গুরুত্ববহ।
বুথ ফেরত সমীক্ষা নিশ্চিত করে দেখিয়েছিল যাঁদের পারিবারিক মাসিক আয় দশ হাজার টাকার কম, তাঁরা কংগ্রেসকে বিজেপির তুলনায় ১১ শতাংশ ভোটে এগিয়ে দিয়েছেন। অন্য দিকে, গেরুয়া দল ভোট কুড়িয়েছে উচ্চবিত্ত গোষ্ঠী থেকে। তাই তো মোদীজি কর্নাটককে ‘গ্লোবাল প্লেয়ার’ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আর কংগ্রেস ফেরি করেছে অভাব ও যন্ত্রণামুক্তির ছোট ছোট স্বপ্ন। শেষ বিচারে লড়াইটা তাই হয়ে দাঁড়ায় বৈভব বনাম দারিদ্রের। বিজেপির কট্টর হিন্দুত্ববাদের মোকাবিলা কী ভাবে করা উচিত সে নিয়ে কংগ্রেস বরাবরই দ্বিধান্বিত। এ কথা স্বীকার করে নিয়েও বলা যায়, এই প্রথম বহুত্ববাদী ভারতের স্বার্থে কংগ্রেস এক বিকল্প রাজনৈতিক আখ্যান উপস্থাপন করল। এতখানি ঐক্যবদ্ধ কংগ্রেস শেষ কবে দেখা গিয়েছে গবেষণার বিষয়। বিজেপির প্রবল বিরোধিতার মুখে প্রচারের শেষ পর্বে কংগ্রেস রক্ষণাত্মক হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মূল ভাবনা থেকে সরে আসেনি। আগামী দিনে প্রতিশ্রুতি রূপায়ণে অটল থাকতে পারলে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত সংজ্ঞা নির্ধারিত হতে পারবে।
তবে, কর্নাটকের রায় কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের বিদায়ঘণ্টা, এমন ধারণা কষ্টকল্পিত। কারণ, হারলেও বিজেপির প্রাপ্ত ভোট শতাংশ অপরিবর্তিত। তা ছাড়া রাজ্যে যে-ই আসুক, কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী— এমন ধারণা পোষণ করেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, অন্তত সমীক্ষা তা-ই জানাচ্ছে। তাঁদের সেই বিশ্বাস টলাতে হলে লোকসভার ভোটকেও আঞ্চলিকতার আবহে আবদ্ধ রাখা জরুরি। আর দরকার মোদীজির বিপ্রতীপে বিশ্বাসযোগ্য সর্বজনগ্রাহ্য এক নেতা, বিরোধীদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস। এই নির্বাচনী ফলাফল এটাও প্রমাণ করল যে, আঞ্চলিক আবেগ এবং স্থানীয় সংবেদকে ধরতে না পারলে সেই দলের পক্ষে সাংস্কৃতিক দিক থেকে অধিকতর পরিচয়বাহী রাজ্যগুলিতে নিজেদের গভীর ভাবে প্রোথিত করা আজ অজ্ঞতার শামিল।
সৌমিত্র মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৬১