নিখিল সুরের ‘সে কালের দলবদল’ (রবিবাসরীয়, ৭-৭) শীর্ষক নিবন্ধ প্রসঙ্গে বলি, বিনয় ঘোষ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’ বইয়ের ৩য় খণ্ডে বলেছিলেন, ‘‘সমাজসংস্কারের বিভিন্ন বিষয় কেন্দ্র করে এইসব গোষ্ঠী প্রধানত দুটি দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদল ছিল সংস্কারপন্থী, আর একদল ছিল সংস্কারবিরোধী।... ইয়ংবেঙ্গল ও ধর্মসভা সংস্কারের পক্ষে ও বিপক্ষে কতকটা চরমপন্থী ছিলেন। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের মধ্যে অনেকে এবং ব্রাহ্মসমাজ দল নরম-চরমের মাঝামাঝি ‘উদারপন্থী’ ছিলেন।’’
বিনয় ঘোষ ‘বাংলার বিদ্বৎসমাজ’ বইয়ে বলছেন, ১৮২৯-এ গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহ ও সহমরণ নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করলে, প্রতিবাদে ১৮৩০ সালের ১৭ জানুয়ারি সনাতনপন্থীরা ধর্মরক্ষার্থে ‘ধর্মসভা’ স্থাপন করেন এবং তখন থেকেই বাংলায় দলাদলি তীব্র ভাবে শুরু হয়। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভাবাজারের রাজা গোপীমোহন দেব ও রাধাকান্ত দেব, কালীকৃষ্ণ বাহাদুর, হরিমোহন ঠাকুর, গোকুলনাথ মল্লিক প্রমুখ রক্ষণশীল অভিজাতরা ‘ধর্মসভা’ তৈরি করে সতীদাহ রদ সংক্রান্ত আইন ও সমাজসংস্কারের বিরোধিতায় পথে নামেন।
যুক্তিনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজসংস্কারে সচেষ্ট হওয়ার জন্য ব্রাহ্মসমাজকে লোকে বলত ‘শীতলসভা’। অন্য দিকে ‘ধর্ম গেল, জাত গেল’ বলে হইচই বাধিয়ে দিত বলে ধর্মসভাকে লোকে বলত ‘গুড়ুমসভা’। বাংলার বিদ্বৎসমাজ ও ধনী পরিবারগুলি তখন কার্যত চারটি দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল—
১) ব্রাহ্মসমাজ, ২) ধর্মসভা, ৩) নাস্তিক দল (ইয়ংবেঙ্গল) ও ৪) মিশনারি দল।
বিনয় ঘোষ বলছেন, ‘‘কলকাতা শহরের নতুন ধনিক বংশেও অনেক পণ্ডিত সভাপণ্ডিতরূপে প্রতিপালিত হতেন। শোভাবাজারের রাজ পরিবারে, ঠাকুর-পরিবারে, মল্লিক-পরিবারে, সিংহ-পরিবারে, বিখ্যাত পণ্ডিতদের সমাবেশ হত।’’ (‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’ ২য় খণ্ড)। বাংলার প্রগতিশীল সমাজসংস্কারপন্থীদের নেতৃত্বে তখন জোড়াসাঁকো পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবার। অন্য দিকে রক্ষণশীলদের নেতৃত্বে কলকাতার সবচেয়ে শক্তিশালী বনেদি পরিবার শোভাবাজারের দেবরা। পাথুরিয়াঘাটার দেওয়ান বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সিমলার আশুতোষ দে, কলুটোলার রামকমল সেন ও মতিলাল শীল প্রমুখ ধনীবাবুরা ধর্মসভায় যোগ দিয়ে সমাজসংস্কারের বিরোধিতা করতে থাকেন। পাশাপাশি সমাজসংস্কারের পক্ষে ব্রাহ্মসমাজ ও ঠাকুর পরিবারের পাশে দাঁড়ান টাকির কালীনাথ ও বৈকুণ্ঠনাথ মুনশি, ভূকৈলাসের রাজা কালীশঙ্কর ঘোষাল, কাশীপুরের রামগোপাল ঘোষ এবং ১৮৫০-এর দশকে শোভাবাজারের দিগম্বর মিত্র, বৌবাজারের রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বাবুরা বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারের কাজে হাত মেলান।
১৮৩২-এর ১২ জুলাই ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলে সতীপ্রথা রদ সংক্রান্ত আইনের পুনর্বিবেচনার আবেদন নাকচ হয়ে গেলে, ১০ নভেম্বর জোড়াসাঁকোর ব্রাহ্মসমাজে ডেভিড হেয়ার, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামলোচন ঘোষ প্রমুখ সংস্কারবাদী নেতারা বিজয় উৎসবে মেতেছিলেন।
১৮৪০-এর দশকে ‘ধর্মসভা’ কার্যত ‘জাতি ট্রাইবুনাল’-এ পরিণত হলেও, বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলন শুরু হলে ধর্মসভা সরাসরি তারও বিরোধিতায় নামে। অবশ্য রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে সে দিন রক্ষণশীলরা প্রায় ৩৭,০০০ স্বাক্ষর-সহ আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠিয়েও, বিধবাবিবাহের প্রচলনকে কোনও ভাবেই আটকাতে পারেননি।
পীযূষ রায়
কলকাতা-৩৪
বুঝেশুনে
‘উন্নাও: বিধায়কের নামে খুনের মামলা’ (৩০-৭) শীর্ষক সংবাদটি পড়লাম। ছোট একটি রিপোর্টে ‘ধর্ষিতা’ কথাটি ব্যবহার হয়েছে ১৫ বার। ধর্ষিতার গাড়ি, ধর্ষিতার বাবা, ধর্ষিতার মা, ধর্ষিতার পরিবার— এই ভাবে মহিলার বিরুদ্ধে ঘটা এক অপরাধকে একমাত্র বিশেষণে পরিণত করার পিছনে বাংলা ভাষাজ্ঞানের অভাব, না সংবেদনশীলতার, বুঝতে পারলাম না। ইংরেজি সংবাদে the victim বা the survivor ব্যবহার করা হয়। বাংলাতেও ‘উক্ত মহিলা’ বা ‘আক্রান্ত মহিলা’ ব্যবহার করা যেতে পারত। স্মৃতিতে ছ্যাঁকা দেওয়ার মতো ধর্ষণ কথাটির পুনঃপুন উল্লেখ যে অন্যায়, বোঝা দরকার। নাম ব্যবহার করা যাবে না— এই মর্মে কোর্টের নির্দেশ আছে, তাই বলে অপরাধ পরিণত হবে সর্বনামসূচক বিশেষণে?
অনিতা অগ্নিহোত্রী
আইআইটি পওয়াই, মুম্বই
খুন ও ব্যাঙ্ক
বৃদ্ধবৃদ্ধাদের উপর নৃশংসতার ঘটনা প্রায়ই খবরে আসছে। লক্ষ্য হয়ে পড়ার নানা কারণ থাকে, বাড়িতে ভাল অঙ্কের নগদ টাকা রাখা তার একটা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা বাড়িতে রাখা ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় সীমাবদ্ধতার দিকনির্দেশ করে।
জাতীয়কৃত ব্যাঙ্কগুলির যে কোনও শাখায় আজ কর্মচারীর অভাব প্রকট। টাকা জমা-তোলার একাধিক কাউন্টার লোকের অভাবে বন্ধ থাকে প্রায় দিন। চন্দ্রযান-২ চাঁদের উদ্দেশে পাড়ি দিল, কিন্তু কাউন্টারের সামনে টাকা তোলার লাইন বেড়েই চলল। সৌজন্যে, কর্মিসঙ্কোচন নীতি। অনেক সময় বয়স্ক ও অশক্তেরা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবু মাসে এক-আধ বার এই বিভীষিকার মুখোমুখি না হয়ে উপায় নেই।
বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে চালু হয়েছিল এটিএম। কিন্তু বর্তমানে এই পরিষেবার বেহাল অবস্থা। প্রায় দিনই টাকা থাকে না। টাকা থাকে তো লিঙ্ক থাকে না। যন্ত্র বিকল। কবে কখন সারানো হবে কেউ বলতে পারেন না। সব ঠিক থাকলেও উচ্চমূল্যের নোটে নগদ প্রদান করা হয়। সেই টাকা ভাঙাতে গিয়ে বচসা বাধে। কাঁচুমাচু মুখে বড় দোকানির কাছে কৃপাপ্রার্থী হয়ে দাঁড়াতে হয়। এক সময় বলা হয়েছিল, এটিএম-এ চাহিদামতো কমমূল্যের নোটও প্রদান করা হবে। তা আজ দুরাশা।
বয়স্ক নাগরিকদের খুনিদের নিশ্চয় ধরা হবে। সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথাও অবিলম্বে ভাবতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যাঙ্কের ঊর্ধ্বতন প্রশাসন একটু দেখুন, বৃদ্ধবৃদ্ধাদের কী ভাবে আরও ভাল এবং যন্ত্রণাহীন পরিষেবা দেওয়া যায়। নির্ধারিত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বয়স্ক এবং অশক্ত গ্রাহকদের বাড়িতে নগদ টাকা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না। অন্তত, বাড়িতে অতিরিক্ত নগদ অর্থ মজুত রাখার কারণে যেন কেউ আক্রান্ত না হন।
বিশ্বনাথ পাকড়াশি
শ্রীরামপুর, হুগলি
হিন্দু রেট
‘জবাব এড়িয়ে দোষারোপেরই রাস্তায় নির্মলা’ (১৩-৭) প্রতিবেদন পড়লাম। নির্মলা সীতারামন কংগ্রেসকে আক্রমণ করে বলেন, ‘‘কংগ্রেস আমলে অর্থনীতি কেন দ্বিগুণ হয়নি। তখন কেন হিন্দু বৃদ্ধির হার চাপানো হয়েছিল।’’
স্বাধীনতার পর বহু দিন ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশ অতিক্রম করেনি। অধ্যাপক রাজ কৃষ্ণ, পরিকল্পনা কমিশনের এক বৈঠকে কিছুটা কৌতুক করে একে ‘হিন্দু রেট অব গ্রোথ’ অভিহিত করেন, হিন্দু সাধুসন্তদের নির্মোহ জীবনযাপন আর অল্পে সন্তুষ্টির কথা মনে রেখে। কথাটা তার পর থেকে ভারতীয় অর্থনীতির চর্চায় স্থায়ী হয়ে যায়। কিন্তু কংগ্রেস জমানাতেই, রাজীব গাঁধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়, মিশ্র অর্থনীতির সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সংস্কারের ফলে, ১৯৮৮-৮৯ অর্থবর্ষে সেই প্রথম দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার হিন্দু রেট অব গ্রোথকে অতিক্রম করে। আবার কংগ্রেস আমলেই, ১৯৯০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছরে, প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও আর অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের দ্বৈত পরিচালনায় এই আর্থিক বৃদ্ধির হার উত্তরোত্তর বেড়ে চলে। রাগের মাথায় বলা অর্থমন্ত্রীর কথা তাই ধোপে টেকে না।
বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়
কুলটি
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।