স্বাধীনতার ৭৫ বছরে গণতান্ত্রিক ভারতের কী অপার মহিমা! পুলিশি হেফাজতে দেশে দিনে গড়ে ৫টি মৃত্যু ঘটছে। ‘ন্যাশনাল ক্যাম্পেন এগেনস্ট টর্চার’ নামক একটি সংস্থা সমীক্ষা করে এই তথ্য জানিয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করতে হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২০২০-র মার্চের রিপোর্ট অনুযায়ী, পুলিশি হেফাজত ও জেল হেফাজতে নথিভুক্ত মৃত্যুর সংখ্যা ১৭,১৪৬। শারীরিক হেনস্থা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও থানায় ঘটছে বেশি। পুলিশ তবে কার রক্ষক?
১৯৬১ সালে এলাহাবাদ হাই কোর্টের বিচারপতি এ এন মুল্লা বলেছিলেন, “পুলিশ হল সুসংগঠিত ক্রিমিনাল বাহিনী।” স্বাধীনতার ১৫ বছর পার হওয়ার আগেই ভারতের বুর্জোয়া গণতন্ত্রের স্বরূপটি দেখিয়ে দিয়েছিল এই উক্তি। প্রশাসন গত ৬০ বছরে আরও নির্মম হয়েছে। স্বাধীনতার পর নতুন ভারতের স্বপ্ন যখন জনমানসে টাটকা, সে সময় বিচারবিভাগেও পড়েছে তার কিছু কিছু ছাপ। তাই ভারতের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল এম সি শিতলবাদ সে সময় বলেছিলেন, “বিচারপ্রক্রিয়ার বাইরে রাখা উচিত পুলিশকে।” অথচ, দিনে দিনে পুলিশই যেন বিচারকর্তা হয়ে উঠেছে। বিচার হওয়ার আগেই চরম শাস্তি দিচ্ছে, নিরপরাধ নাগরিকের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে পুলিশের মাত্রাছাড়া নির্যাতন। সরকারি হিসাবে শুধু উত্তরপ্রদেশেই গত সাড়ে চার বছরে যোগী শাসনে মোট ৮৪৭২টি এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার আন্দোলন ও গণআন্দোলন করতে গিয়ে অনেককে জেলে নৃশংস শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে।
বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা আজ গণতন্ত্রের বদলে দমনতন্ত্রের দিকেই ঝুঁকে। তাই আমলা-প্রশাসন-পুলিশের পদতলে পিষ্ট বিচারব্যবস্থা প্রশাসনের দাসত্ব করতে বাধ্য হচ্ছে। অবাধ্য হলে, সরকার ও ক্ষমতাবানদের হুকুম না শুনলে বিচারকও খুন হয়ে যাচ্ছেন। সে জন্য সাধারণ মানুষের আইনি সুরক্ষা নিতান্তই কথার কথা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি যত একচেটিয়া রূপ নিচ্ছে, প্রশাসনিক স্তরে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। সরকার ক্রমশ বেশি করে সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে, পুলিশ-প্রশাসনকে ব্যবহার করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করছে।
সোমা নন্দী
কলকাতা-৯
এখন আর তখন
‘পুরনো সব ভাল?’ (সম্পাদক সমীপেষু, ২৬-৮) আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু সব যুক্তিরই পাল্টা যুক্তি থাকে। যদি পুরনো সব ভাল নয়, তবে নতুন সব ভাল? আমার অশীতিপর মা বলেন, ‘গেছে দিন ভাল, আসছে দিন খারাপ’। কথাটা তাৎপর্যপূর্ণ। ‘গেছে দিন’ ভাল, কারণ তা অতীত। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। অতীতের ভাল-মন্দ বর্তমানে স্মৃতি। আর ‘আসছে দিন’ ভবিষ্যতের গর্ভে, অজানা, অচেনা, তাই খারাপ। অন্য ভাবে ভাবলেও কথাটা ভুল নয়।
আমার মাতামহ-মাতামহী আজ থেকে ৩৫ বছর আগে মারা গিয়েছেন। এক জন ৮০, অন্য জন ৮২ বছর বয়সে। থাকতেন সুন্দরবন অঞ্চলের গোসাবা ব্লকের ঝাউখালি গ্রামে। তখন বিদ্যুৎ, পাকা রাস্তা, দূরদর্শন, দূরভাষ, ডাক্তার, শৌচালয়, পাকা বাড়ি, মোটরগাড়ি ছিল না। নদীপথে আর হেঁটে মানুষ মাইলের পর মাইল চলত। সুন্দরবন নদীনালার দেশ। ‘খেত ভরা ফসল, গোলা ভরা ধান, আর মাছ ভরা পুকুর’ ছিল। অভাব-অনটন ছিল না। ঘর-বাড়ি ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে গ্রামের বাইরে যেতে হত না।
দাদু-দিদিমা কোনও দিন কঠিন অসুখে ভোগেননি। অসুখ করলে গ্রামের ডাক্তার-কবিরাজের ওষুধ খেয়ে ভাল হয়ে যেতেন। এখন চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। অথচ, নতুন ‘সর্দি-কাশি-জ্বর’ অতিমারির আকার ধারণ করেছে। কত হাসপাতাল, ডাক্তার, তবুও বিনা চিকিৎসায় লোক মারা যায়। সরকারি হাসপাতালে পরিষেবা পায় না বলে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়। আগে পেয়াদা, মহাজন, জোতদার, জমিদারদের জুলুম ছিল। এখন পুলিশ, অফিসার, নেতা, মন্ত্রীদের জুলুম আছে।
আগে ঘরে-ঘরে পুকুর ছিল। এখন ভূগর্ভস্থিত অমূল্য জল পাম্প চালিয়ে তুলে ব্যবহার হচ্ছে। জলের স্তর নেমে যাচ্ছে। জলকষ্ট বাড়ছে। আগে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, আকাল হত। খাদ্যাভাবে মানুষের মৃত্যু হত। এখনও মহামারি হয়। খাদ্যাভাবে মানুষের মৃত্যু হয়। আগে ঘরে বা গ্রামেই ধানের বীজ থাকত। এখন উন্নত প্রজাতির ধানের বীজ বাজার থেকে কিনতে হয়। আগে গোবর সার ব্যবহার হত। এখন রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। আগে শুধু বর্ষাকালেই চাষ হত। এখন সারা বছর ভূগর্ভের জলে চাষ হয়। তবুও, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টিতে চাষের-ফসলের প্রভূত ক্ষতিসাধন হয়।
আগে মানুষের জীবনে অনেক সময় ছিল। পাড়াপড়শি ঝগড়া যেমন করত, সুখ-দুঃখের ভাগীদারও তেমন হত। এখন সবাই নিজেরটুকু নিয়েই ব্যস্ত। আগে চোর-ডাকাত ছিল। এখন আরও ‘উন্নত’ সংস্করণ সাইবার ক্রাইম আর সন্ত্রাসবাদী আছে। মানুষের হিংসা, স্বার্থপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিযোগিতা বেড়েছে। জীবন যান্ত্রিক হয়েছে। পুরনো দিনের জীবন-জীবিকা যেমন সহজ-সরল ছিল, এখন তেমনই কঠিন আর জটিল হয়েছে। এক দিন মানুষ হয়তো অন্য গ্রহে বসতি করবে। এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে মুহূর্তেই পৌঁছে যাবে। সভ্যতা উন্নতির শিখরে পৌঁছবে। তবুও বলা হবে, ‘পুরনো দিন ভাল ছিল’, অন্তত প্রকৃতি-পরিবেশ যা সভ্যতার আধার, তা দূষণমুক্ত ও বিশুদ্ধ ছিল।
সমরেশ কুমার দাস
জালুকি, নাগাল্যান্ড
উত্তম গুণ
অশোক দাশের ‘ঢাকা পড়ল গুণগুলো’ (সম্পাদক সমীপেষু, ৪-৯) পড়ে আশ্চর্য হলাম। উচ্চারণ যথাযথ করা অভিনেতার কাজ নয়, সেই কাজ বাচিকশিল্পীর। অভিনেতা চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে পারছেন কি না এবং সেই চরিত্র ফুটিয়ে তোলার সময় তাঁর মুখভঙ্গি, স্বরভঙ্গি ইত্যাদি ওই চরিত্রের কতটা অনুসারী হচ্ছে, তা-ই অভিনেতার কাজের দক্ষতা প্রমাণ করে। পত্রলেখক বলেছেন, উত্তমকুমার দক্ষ অভিনেতা, কিন্তু সম্পূর্ণ নন। সম্পূর্ণতা বলতে যদি নিখুঁত অভিনয় বলা হয়, তা হলে সত্যজিৎ রায়ের কথা বলতে হয়। তিনি বলেছিলেন, নায়ক-এ উত্তমকুমারের অভিনয়ে তিনি কোনও ত্রুটি খুঁজে পাননি।
উত্তমকুমারের উচ্চারণে জড়তা ছিল— এ কথাও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা উত্তমকুমারের উচ্চারণে ইংরেজির যে টানের কথা বলা হয়, তা উনি চরিত্র অনুযায়ী প্রয়োগ করতেন। সপ্তপদী-র শুরুর দিকে তাঁর উচ্চারণে কোনও ইংরেজি টান নেই। স্ত্রী, মরুতীর্থ হিংলাজ বা খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন-এ উত্তমকুমারের সংলাপ উচ্চারণে ইংরেজি টান নেই। এর থেকেই বোঝা যায় এটা ওঁর উচ্চারণদোষ নয়, বরং সুচিন্তিত প্রয়োগকৌশল। যে কারণে শেষ অঙ্ক, বিচারক, কিংবা নায়ক-এ উচ্চবিত্ত মানুষদের চরিত্রায়ণে তিনি ইংরেজি টানের প্রয়োগ করেছেন। চৌরঙ্গী-র চরিত্রটিতে প্রতিনিয়ত স্যাটা বোসের বিদেশি আপ্যায়নের কারণে দেখা যায় চরিত্রটি যখন অতিথি অভ্যর্থনা করছে, তখন তার উচ্চারণে ইংরেজি টান, অপর দিকে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় বা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রের সঙ্গে যখন কথা চলছে, তখন বাংলা উচ্চারণে শুধুমাত্র বাঙালিয়ানার ছাপ। উচ্চারণে জড়তা থাকলে বাঙালি সমাজ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করত। তা হয়নি। উত্তমকুমারের হিন্দি ইন্ডাস্ট্রিতে সফল না হওয়ার আভাসও দেওয়া হয়েছে। তাঁর কারণ আছে। অধিকাংশ হিন্দি বাণিজ্যিক সিনেমার অতিরঞ্জিত অভিনয়, মশলাদার গান, চটকদার নাচ যে অভিনয়ের সংজ্ঞা হতে পারে না, সেটা তিনি জানতেন। তাই হয়তো তিনি কোনও দিন বলিউডে সে রকম ‘হিট’ হননি, যেমন হতেন না মতিলালের মতো অসামান্য অভিনেতারা। কিন্তু ভুললে চলবে না, শক্তি সামন্তের ছবিতে উত্তমকুমার হিন্দি ইন্ডাস্ট্রিতেও জনপ্রিয় হন।
আর্জব দে
কোচবিহার