‘দেশে ভাঙনতন্ত্র চলছে’ (১-৭) শীর্ষক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন করতে চাই, দেশের ভাঙনতন্ত্র ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে? এর সূত্রপাতের ক্ষেত্র কিন্তু ১৯৪৭ সালের আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল বা হচ্ছিল। কারণ, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ গোষ্ঠীর হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছিল বর্ণহিন্দু শাসক গোষ্ঠীর হাতে এবং তা হয়েছিল দেশটিকে তিন টুকরো করার ভিতর দিয়েই। ১৯৪৮ সালেই বিতর্কিত জায়গাটিতে রাতের অন্ধকারে রামের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। তাই, একটা গোষ্ঠী সক্রিয় ছিলই।
ভাঙনতন্ত্র শুরুর একটি উদাহরণ— সংবিধান ও নাগরিকত্ব আইন (১৯৫৫) সংশোধন। পূর্বে ছিল, জন্মস্থান ভারত হলেই নাগরিকত্ব মিলবে। ১৯৮৬ সালে সংশোধনী এনে বলা হল, পিতামাতার মধ্যে যে কোনও এক জনকে ভারতের নাগরিক হতে হবে। এখানে যে ভাঙনের সুর তোলা হল, সেই সুরই পরবর্তী কালে শাসক গোষ্ঠীর উত্তরাধিকাররা গর্জনে পরিণত করলেন ২০০৩ সালের ‘কালা আইন’-এ। পরিণাম আমরা দেখেছি অসমে।
ভাঙনতন্ত্রের দোসর ‘বিক্রয়তন্ত্র’— চুপি চুপি রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেচে দেওয়া। সূচনাও কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে, নরম হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসের হাত ধরে। সেই চারাগাছটিকে আজ মহীরুহে পরিণত করেছেন হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। উদ্দেশ্য, ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করা। সংবিধানকে কোমায় পাঠিয়ে হোক আর সংবিধানকে পাল্টে দিয়ে, লক্ষ্য কিন্তু এক ও অদ্বিতীয় হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপন।
সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেডকর ১৯৪৫ সালেই ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার বিষয়ে ভারতবাসীকে সতর্ক করেছিলেন পাকিস্তান অর দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া বইয়ে। বলেছিলেন— “হিন্দুরাজ যদি একটি বাস্তব ঘটনা হয়ে ওঠে, তবে নিঃসন্দেহে তা দেশের পক্ষে চরম বিপদ। হিন্দুরা যা বলে বলুক, কিন্তু হিন্দুত্ববাদ স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের ক্ষেত্রে একটি বিভীষিকা। সেই হিসেবে তা গণতন্ত্রের শত্রু। যে কোনও মূল্যে হিন্দুরাজকে প্রতিরোধ করতে হবে।” এই সতর্কবার্তাকে অবজ্ঞা করেছেন দেশের শাসক গোষ্ঠী, বুদ্ধিজীবী মহল, এমনকি যাঁরা তথাকথিত ‘আম্বেডকরাইট’, তাঁরাও।
আম্বেডকর কেবলমাত্র সতর্কই করেননি, কী ভাবে হিন্দুরাজ স্থাপনকে প্রতিহত করা যাবে বা হবে, তার কথাও বলেছেন বহু বার। মূকনায়ক পত্রিকায়, মাহার ভাষণ, লাহোর ভাষণ (যে ভাষণটির গ্রন্থরূপ অ্যানাইহিলেশন অব কাস্ট) এবং সর্বোপরি তাঁর রচিত ভারতের সংবিধানের ধারায় ধারায়। শুধুমাত্র ভারতের সংবিধানকে যদি ঠিক ভাবে প্রয়োগ করা হত, তা হলে আজকে এই ভাঙনতন্ত্রের সর্বব্যাপী রূপ দেখতে হত না। অতএব ভাঙনতন্ত্রকে ঠেকানোর প্রধান উপায় হল দেশকে সংবিধান অনুসারে চালিত করা। রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের চেষ্টাকে যে কোনও মূল্যে প্রতিরোধ করতে হবে।
চণ্ডাল বিশ্বাস, নেউলিয়া, নদিয়া
সত্যের ভয়
‘অল্ট নিউজ়’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ জ়ুবেরের গ্রেফতারি নিয়ে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় এবং অর্ক দেব-এর দু’টি প্রবন্ধ (‘আগুন নিজে জ্বলে না’ এবং ‘তিনি মিথ্যার বিরুদ্ধে, তাই শত্রু’, ৮-৭) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং উদ্বেগের। ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত আর তার থেকে অশান্তি ও দাঙ্গার আশঙ্কা থেকে জ়ুবেরের এই গ্রেফতার আপাত ভাবে হাস্যকর (চল্লিশ বছর আগেকার একটি সিনেমার ক্ষুদ্র অংশবিশেষ তুলে ধরার অপরাধে) মনে হলেও তা পরম দুশ্চিন্তার।
তবে মহম্মদ জ়ুবেরের গ্রেফতার হওয়া শুধু যেন সময়ের অপেক্ষা ছিল। মিথ্যার উন্মোচন আর সত্যের উদ্ঘাটনের এ রকম নিরলস সমাজকর্মীর সমাজে এই বাধাহীন বিচরণ বেশি দিন বোধ হয় চলে না। বছরখানেক আগে একটি অনলাইন সাক্ষাৎকারে জ়ুবের নিজেই তাঁর অশুভ কোনও পরিণতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। মনে হয়, তাঁর কাছে এই গ্রেফতারি আশঙ্কার হলেও বিস্ময়ের ছিল না। তবু তা যখন ঘটেই যায়, তখন মুক্ত চিন্তা আর বাক্স্বাধীনতার উপর এই খড়্গাঘাত আমাদের আতঙ্কিতই করে। এখন থেকে তা হলে শুধু অমিতমিথ্যাচারী (গালভরা নাম— ‘ফেক নিউজ়’) আর ঘৃণাভাষণে পটু ক্ষমতা-ভক্তরাই কথা বলবে! সত্য কি আজ থেকে তা হলে লুকিয়ে রাখার বস্তু? অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ঠিক বিশ্লেষণই করেছেন, “আগুন জ্বলার আশঙ্কা এমন বেড়ে গেল কেন? এর পিছনে সামাজিক অসহিষ্ণুতার ভূমিকা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেটা ব্যাধি নয়, ব্যাধির লক্ষণ। ব্যাধির মূলে আছে ক্ষমতার কারবারিরা, যারা এই বিষাক্ত অসহিষ্ণুতাকে সৃষ্টি এবং লালন করে চলেছে।” সদ্যপ্রয়াত, ভারতের রাজনীতি আর দাঙ্গার ইতিহাস নিয়ে বহু বইয়ের লেখক, গবেষক, সমাজতাত্ত্বিক পল ব্রাস কিংবা বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আসগর আলি ইঞ্জিনিয়ার তাঁদের তথ্যে, বিশ্লেষণে বার বার প্রমাণ করেছেন ওই একই কথা— নানা উপলক্ষে যে আগুন জ্বলছে বা জ্বলার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, সচরাচর তা নিজে জ্বলে না, তাকে জ্বালানো হয়। ভারতে আজ অবধি কোনও দাঙ্গাই নিজে থেকে ঘটেনি, বার বার ক্ষমতার স্বার্থে দাঙ্গা বাধানো হয়েছে। প্রশাসন বা ক্ষমতা না চাইলে দাঙ্গা হয় না।
তাই জ়ুবেরের গ্রেফতারের আসল কারণটি পুলিশের দর্শানো কারণ নয়। এটা আসলে একটা বার্তা। স্বৈরতন্ত্র আর অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বার্তা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বার্তা। আসলে ‘ফেক নিউজ়’ দিয়ে জনমানসে বিভ্রান্তি তৈরি করে সহজে যুদ্ধে জেতা (অর্থাৎ, ভোটে জেতা) স্বৈরতন্ত্র সত্যিকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। তাই মিথ্যা খণ্ডনকারী সত্যকে আগে থামানো দরকার। কারণ, মিথ্যা ছাড়া স্বৈরতন্ত্র টিকতে পারে না। সত্যই তার পরম শত্রু। তাই সম্প্রতি ‘ফেক নিউজ়’-এর এত রমরমা। এবং এই খবর ছড়ানো মানুষদের এত গুরুত্ব!
মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন ‘ফেক নিউজ়’ মানুষের মনকে বিকলাঙ্গ করে দেয়। মানুষের মনের বিশ্লেষণী ক্ষমতা (মূলত অডিয়ো ভিসুয়াল) ‘ফেক নিউজ়’ লুপ্ত করে দেয়। তার পর সেই মনের দখল নেওয়া আর তাকে চালিত করা অনেক সহজ হয়ে যায়। মানুষ বুঝতেও পারে না, চেতনাগত ভাবে সে আক্রান্ত, তার স্বাধীন বুদ্ধির লোপ হয়েছে। ওই একই কারণে ইন্টারনেটে ‘ফ্যাক্ট চেক’-এর হাজারো অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও সে তা ব্যবহার করার কথা মাথাতেই আনে না। অলস সমাজ-মনের মিথ্যার প্রতি এই দুর্নিবার আসক্তি যেন আজকের সমাজের এক অনতিক্রম্য বৈশিষ্ট্য। মিথ্যার অভিশপ্ত ফল আহারের জন্য সে মুখিয়ে বসে আছে। এ যেন এক শয়তানের আবর্ত— ‘ফেক নিউজ়’ মানুষের মনকে বিকলাঙ্গ করে, আর পঙ্গু মন অসত্য (কিন্তু, প্রিয়) খবরের জন্য মুখিয়ে থাকে। সেই খবর, যা তাকে সচেতন করে না, তাকে ভাবায় না, শুধুমাত্র উত্তপ্ত করে, অজানা আতঙ্কে আতঙ্কিত করে, একমুখী করে আর হিংস্র করে তোলে।
এই সমাজ-মনই ক্ষমতার বড় কাঙ্ক্ষিত বস্তু। দেশের ৭৫ কোটি মোবাইল গ্রাহকের (ভোটারের, উপভোক্তার) মন যদি একটা ক্লিকেই দখল নেওয়া যায়, ক্ষমতার কাছে এর থেকে মজার জিনিস আর কী হতে পারে! আর এই মজাটাকেই যদি প্রতীক সিংহ আর মহম্মদ জ়ুবের নষ্ট করতে উদ্যত হন, তা হলে কারাগারের অন্ধ কুঠুরি ছাড়া আর কোনও জায়গা তাঁদের জন্য বরাদ্দ থাকতে পারে কি?
অনিন্দ্য ঘোষ, কলকাতা-৩৩
খুঁটির ছুটি?
বিগত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে ‘খুঁটিপুজো’র বহর। প্রায় প্রতিটি বড় পুজোর উদ্যোক্তারা তিন-চার মাস আগে থেকে ‘খুঁটিপুজো’ দিয়ে পুজোর বাজনা বাজিয়ে দেন। জাঁকজমক করে, সেলেব্রিটিদের দিয়ে যে ভাবে প্রতিযোগিতার আবহে খুঁটিপুজো শুরু হয়েছে তাতে আশঙ্কা হয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না খুঁটিপুজো উপলক্ষে ছুটি ঘোষণা করে দেন।
ইন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বাগনান, হাওড়া