—ফাইল চিত্র।
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারিয়ে যাচ্ছে মানবিক বোধ’ (২১-১১) শীর্ষক প্রবন্ধে উঠে এসেছে প্যালেস্টাইনের উপর ইজ়রায়েলের অমানবিক আস্ফালন। আর সেই আস্ফালনে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে জনপদ, ত্রাণশিবির থেকে হাসপাতাল ও বিদ্যালয়। জ্বলছে গণচিতা। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস; তবুও যুদ্ধবাজরা যুদ্ধ চায়।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে চার দিকের পরিবেশ পরিস্থিতি অনুধাবন করলে সহজেই বোঝা যায়, দিন দিন মানুষ এক অমানবিকতার নামাবলি গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছে। মানবিক সত্তা ক্রমক্ষীয়মাণ। সময় বলে দিচ্ছে কান্তিময় আলোর বড় অভাব। গগনচুম্বী আমিত্ব আর অহংবোধে অন্ধ রাষ্ট্রনেতারা আজ কোনওরূপ প্রতিদ্বন্দ্বী রাখতে নারাজ। সেই চিরশত্রু প্রতিদ্বন্দ্বীও যে এক দিন বন্ধু হয়ে উঠতে পারে, সেই বোধ, সহনশীলতা, সহমর্মিতা কোথায়? নানান প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে হিংস্রতার চিত্রনাট্য প্রদর্শনে উন্মত্ত পৃথিবী। রবীন্দ্রনাথের ‘খেয়া’ কবিতায় রাষ্ট্রনায়কদের স্বরূপ এ ভাবেই ধরা পড়েছে— “পৃথিবীতে কত দ্বন্দ্ব, কত সর্বনাশ,/ নূতন নূতন কত গড়ে ইতিহাস—/ রক্তপ্রবাহের মাঝে ফেনাইয়া উঠে/ সোনার মুকুট কত ফুটে আর টুটে!” আসলে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। অন্য ভূখণ্ডকে শুধু দখল নয়, তার মানুষগুলোকে নির্মম ভাবে হত্যা করে সেখানকার খনিজ সম্পদকে লুণ্ঠন করাই যেন শাসকের ধর্ম। আর যদি বিরোধ বাধে ধর্মের সঙ্গে ধর্মের, তা হলে তো শুধু মুহূর্তের অপেক্ষামাত্র। যেমন করে অতীতে হিটলার মেরেছিলেন ইহুদিদের, ঠিক তেমন করেই আজ ইজ়রায়েলের বেনজামিন নেতানিয়াহু মারছেন প্যালেস্টাইনিদের। ইতিহাস রোমন্থনে দেখা যায়, দু’দু’টি বিশ্বযুদ্ধের মূলে আছে পারস্পরিক বিদ্বেষ, আছে লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা। সভ্যতা যত দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে, ততই পলেস্তারার মতো খসে খসে পড়ছে আমাদের মানবতার খোলস। এখনও যুদ্ধ শেষ হল না রাশিয়া-ইউক্রেন বা ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইনের! আর এই জ্বলন্ত চুল্লিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে কিছু কিছু দেশের রাষ্ট্রনেতারা। অন্য দেশগুলিও তা দেখে চলেছে। প্রতিবাদ দূর অস্ত্। রাষ্ট্রপুঞ্জও কাঠের পুতুলের মতো এ সমস্ত দেখছে। যার নিজস্ব কোনও সত্তা নেই, শক্তি নেই, আছে বাক্সর্বস্বতা।
চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছে মানবিকতা আর মূল্যবোধগুলো। তবু আমরা আশাবাদী।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
অধরা স্বপ্ন
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি প্রাসঙ্গিক। সভ্যতার অগ্রগতি যতই হচ্ছে, মানুষের মানবিকতা বোধ ততই লোপ পাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ কিংবা ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্ব এগুলোর প্রমাণ দিচ্ছে। রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়— কথাটা কত সত্যি, এই যুদ্ধগুলো তারই প্রমাণ দিচ্ছে। অস্ত্রের আঘাতে সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, আর এক দল তা দেখে পৈশাচিক উল্লাসে মত্ত। নিরপরাধ অসহায় মানুষগুলোর অবস্থা দেখে মনে হয়, সত্যিই কি আমাদের মানুষ বলা যায়? স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, মানুষের মধ্যেই পশুত্ব, মানুষের মধ্যেই দেবত্ব। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত দেবত্ব। সত্যিই কি আমরা মহাপুরুষদের বাণী শুনি বা তাঁদেরকে মানি? আজ মানবসমাজ ধ্বংস হবে তাদের ভুল কাজের জন্য। অমৃতের সন্তান মানুষ কবে অমৃতের রসাস্বাদন করবে? কবি বলেছেন, জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? হায়, কবির এই বাণী যুদ্ধপ্রিয় মানুষের কাছে অবান্তর পাগলের প্রলাপ। মানুষের ভিতরের শুভবুদ্ধি যত দিন না জাগছে, সুখী পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে। তার বদলে হিংস্র, নির্দয় এক পৃথিবীই হবে আমাদের ভবিতব্য।
অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
অ-মানবিক
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘হারিয়ে যাচ্ছে মানবিক বোধ’ পড়ে আশঙ্কা জাগল। মানুষ আর অমানুষের সংজ্ঞা ও সামাজিক অবস্থানের সীমানা অচিরেই না এক হয়ে যায়। মানব জীবনের সার্থকতা অমানবিক বোধের উত্তাল তরঙ্গে হাবুডুবু খেতে দেখার ঘটনা বিশ্বময় নিয়মিত হচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়ত সংবাদপত্র ও মিডিয়ার মাধ্যমে ভয়াবহতার সেই ছবি দেখতে দেখতে সহনশীল ও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সে দু’টি দেশের যুদ্ধ হোক, বা সন্ত্রাসবাদী হামলা হোক, বা অনৈতিক-অবিবেচক কাজকর্মে লিপ্ত থাকা ব্যক্তিবর্গের অত্যাচার হোক। সবার পিছনে ওই এক কথা— মূল্যবোধ বা মানবিক বোধের প্রকট অভাব। অমানবিক বোধের উৎসস্থল লোভ ও হিংসার দাদাগিরি। লোভাতুর মানুষজনের চাওয়া-পাওয়ার সত্যিই শেষ নেই। সেই চাওয়া-পাওয়ার পথের কাঁটাকে যে কোনও মূল্যে বিনষ্ট করতে এতটুকুও হাত কাঁপছে না মানুষের, বা তারা দু’বার ভাবছে না। কারণ, এটা তাদের কাছে শিশুদের পুতুল খেলার মতো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। ক্রমশ বিশ্বময় সে খেলা জাঁকিয়ে বসছে।
বর্তমান দুনিয়ায় অমানবিক ও অসামাজিক কাজকর্মের বহর দেখে এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, এ প্রজন্মে বোধ হয় এর পরিবর্তন আর দেখা যাবে না। অমানবিক কাজকর্মের প্রতিরোধের ভূমিকায় যারা, সেই রাষ্ট্রপুঞ্জও আজ কেবল নীরব দর্শক। কারণ, যারা ক্ষমতাবান, স্বেচ্ছাচারী, তারাই তো সেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাথার উপর বিরাজমান। ইজ়রায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে অমানবিক যুদ্ধে হাজার হাজার শিশু ও নিরীহ মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখতে হচ্ছে কিছু শক্তিশালী আর বিত্তবান দেশের পরোক্ষ মদতের কারণে, যা অমানবিকতার আর একটা দিক। প্রবন্ধকার বলেছেন, হারিয়ে যাচ্ছে মানবিক বোধ। বিশ্ব জুড়ে যে অমানবিক কাজকর্মের তাণ্ডব চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে মানবিক বোধ ‘হারিয়ে যাচ্ছে’ না বলে ‘হারিয়ে গিয়েছে’ বলাটাই আমার কাছে শ্রেয় মনে হচ্ছে। কারণ, অমানবিক কাজকর্মের মাধ্যমে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দুর্বলের প্রতি শোষণের স্বাদ বা দাদাগিরি দেখানোর যে সুযোগ আসছে, সেখান থেকে মানবিক বোধের পুনরুদ্ধার বা জাগরণ আর সম্ভব কি না, তা ভবিষ্যৎই বলবে। মানবিক বোধের দর্শন অতি তুচ্ছ কাজে বা স্থলেই পাওয়া যায় না, দেশ বা যুদ্ধ তো অনেক বড় ব্যাপার।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
যুদ্ধ বন্ধ হোক
আমরা কেন ভাবতে পারি না পৃথিবীকে একটি গোটা দেশ হিসাবে? আকাশ-ছাদের তলার ঘরবাড়ি। সবাই আমাদের প্রতিবেশী। অথচ, প্যালেস্টাইন-ইজ়রায়েল যুদ্ধ আজকের নয়। সংঘাত চরম আকার ধারণ করে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে প্রতিবেশী দু’টি দেশ। জন্মলগ্ন থেকেই একটু বিরতি নিয়ে তার লক্ষ্য যুদ্ধে যোগ দেওয়া! এখন তাতে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ অকাতরে পোকার মতো মারা পড়ছে, আহত হচ্ছে লাখো লাখো! আর পরিবেশও মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পৃথিবী পুড়ছে।
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে যুদ্ধ! যেমন দেড় বছরের কাছাকাছি সময় ধরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে! জানি না এর শেষ কোথায়? রাষ্ট্রপুঞ্জ শান্তি স্থাপনের জন্য কতখানি চেষ্টা করছে? মানুষের শান্তি কোথায় হারাল? পৃথিবী যদি একটাই দেশ হয়, আর তার পরিজনরা যদি পৃথিবীর মানুষই হয়— তা হলে এ ভাবে যুদ্ধ চলতে পারে না! মানবতাই শেষ কথা হওয়া প্রয়োজন। অত্যাধুনিক যুগে বসবাস করেও কেন আমাদের যুদ্ধের পরিবেশ থেকে নিষ্কৃতি নেই? আমরা শিহরিত হচ্ছি! যুদ্ধে আক্রান্ত হয়েই বেঘোরে মারা যাব? এ কথা ভাবতেই পারি না। তাই পৃথিবীর শুভমানস একত্রিত হোক। একটা মধ্যস্থতা করুক। হিংসা নয়, যুদ্ধ নয়, মৃত্যু নয়। আমরা চিৎকার করে আবেদন করি বন্ধ হোক যুদ্ধ।
বিবেকানন্দ চৌধুরী, কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান