‘সাধারণ মানুষের স্বার্থে ঘা’ (১৬-৩) নিবন্ধে প্রসেনজিৎ বসু ঠিক প্রশ্ন রেখেছেন— রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত কাদের স্বার্থে? বর্তমান সরকার শিখণ্ডী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন ব্যাঙ্কগুলোর পরিচালন কাঠামোর পুনর্মূল্যায়নের জন্য কমিটির পেশ করা রিপোর্টকে। অন্য সব কমিটির রিপোর্টই যে সরকার মেনেছে বা মানতে বাধ্য, তা কিন্তু নয়। আসলে এই রিপোর্টে সরকারের লাভ, এই জন্যই এটাকে বাস্তব রূপ দিতে এত আগ্রহ। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের প্রতিবাদে দেশ জুড়ে দু’দিনের ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের ধর্মঘটকে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন সমর্থন জানিয়েছেন, এবং বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্তকে সরকারের ভুল বলে আবার অভিহিত করেছেন।
বাস্তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর অনাদায়ি ঋণের জন্য দায়ী মূলত বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলিই, এবং এর পিছনে আছে রাজনৈতিক নেতাদের মদত। আজ বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলো যে ভাবে বাজার দখল করছে, তার জন্য শুধুমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর অক্ষমতাকে দায়ী না করে, এগুলির পরিচালন ব্যবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। এবং কড়া নজরদারির স্বাধীনতা দিতে হবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে। লেখক ঠিকই বলেছেন যে, সম্প্রতি ইয়েস ব্যাঙ্ক, ধনলক্ষ্মী ব্যাঙ্ক, লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক, সাউথ ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক প্রভৃতি বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোতে লোকসানের বহর বেড়ে প্রায় দেউলিয়ার পথে যাওয়ায় সরকারকে হস্তক্ষেপ অবধি করতে হয়েছে। এখন ‘এফআরডিআই’ আইন যদি যে ভাবেই হোক সরকার চালু করতে পারে, তবে এই বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলো বন্ধ হলে সরকারের কোনও দায় থাকবে না। যার অর্থ, আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষিত নয়। সে দিক দিয়ে এখনও অবধি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ফেল করার কোনও নজির নেই। তাই আমানতকারীদের সুরক্ষা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বজায়ের স্বার্থে সরকারের উচিত বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসা।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
ব্যবহারই পরিচয়
‘সাধারণ মানুষের স্বার্থে ঘা’ নিবন্ধে প্রসেনজিৎ বসু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি দুর্বল হয়ে পড়ার কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি যত দুর্বল হয়ে পড়ছে, বেসরকারি ব্যাঙ্ক ততটাই ফুলেফেঁপে উঠছে। উঠবে না কেন? যে কোনও বেসরকারি ব্যাঙ্কে গেলে কর্মীদের আপ্যায়নে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। তাঁদের দক্ষতা, গ্রাহক পরিষেবা বা প্রযুক্তি যে কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চেয়ে যে হাজার গুণ ভাল, এ নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি দুর্বল হয়ে যাওয়ার পিছনে যতটা সরকারের অবদান, তার চেয়ে বেশি অবদান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককর্মীদের অদক্ষতা, এবং উদ্ধত মনোভাবের। লেখক অভিযোগ করেছেন, মোদী সরকার “রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বেচে দিতে উদ্যত হয়েছে, সেটা সাঙাততন্ত্রের একটা চরম নিদর্শন।” নরেন্দ্র মোদী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে বেচতে উদ্যত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল মোদী ক্ষমতায় আসার আগেই মনমোহন সিংহের আমলে। ভারতীয় ব্যাঙ্কের পরিচালন-কাঠামো পুনর্মূল্যায়নের জন্য যে কমিটি আছে, সেই কমিটিই তো প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করে তৎকালীন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজনের কাছে। ওই কমিটির রিপোর্ট জমা পড়েছিল ২০১৪ সালের ১২ মে, আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিল্লিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন ২৬ মে।
রতন চক্রবর্তী, উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
তফাত কোথায়
‘সাধারণ মানুষের স্বার্থে ঘা’ পড়ে দীর্ঘ ব্যাঙ্কিং জীবনের অনেক কথা মনে পড়ল, যেগুলো জানানো খুবই জরুরি। ১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হয়েছিল পুঁজিপতিদের হাত থেকে দেশের অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্যে, ব্যাঙ্কিংব্যবস্থা সারা ভারতের সাধারণ মানুষের দরজায় পৌঁছে দিয়ে তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্যে। সেখানে রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি ছিল অর্থনীতি। গরিব চাষি কাচের দরজা ঠেলে ঢোকার সাহস পেলেন। ইন্দিরা গাঁধীর উপদেষ্টা অশোক মিত্রের মাথা থেকে বার হল ডিআরআই লোনের নকশা, যাতে গরিব চাষি লোন পেলেন মাত্র ৪% সুদে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক নিয়ম করল, প্রতি ব্যাঙ্ককে তার সমস্ত ঋণের ৪০% দিতে হবে ‘প্রায়োরিটি সেক্টর’-এ, মানে গরিবদের। লাফিয়ে লাফিয়ে ব্যাঙ্কের শাখা বাড়তে লাগল। ভারতের গ্রাম ব্যাঙ্কের মুখ দেখল।
প্রাইভেট ব্যাঙ্ক এক জন বড়লোকের কাছ থেকে ১০০ টাকা লাভ করে, আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ১০ জনের কাছ থেকে ১০ টাকা করে লাভ করে। প্রাইভেট ব্যাঙ্কের মূল লক্ষ্য হল লাভ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের প্রধান লক্ষ্য দেশের উন্নতি, তার পর লাভের কথা।
সাধারণ পরিবারের ঘরের ছেলে যে ব্যাঙ্কে চাকরি পেল, তার কারণ ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ। সারা ভারতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ ৩০ হাজার। প্রাইভেট ব্যাঙ্কে তফসিলি জাতি, জনজাতি, ওবিসিদের আলাদা সুযোগ ছিল না। ছিল না কর্মীদের হয়ে কথা বলার জন্য কোনও ইউনিয়ন, বা চাকরির নিরাপত্তা। প্রাইভেট ব্যাঙ্কের লাভের টাকা নিজের ঘরে যায়, আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের টাকা দেশ গড়তে সাহায্য করে। নোটবন্দির সময়ে ব্যাঙ্কের কর্মীরা প্রায় ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করেছেন। জনধন যোজনার অ্যাকাউন্টের ৯৯% রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কই খুলেছে। তা হলে ব্যাঙ্ক বেসরকারি করার কারণ কী? অনাদায়ি ঋণের জন্যে ব্যাঙ্ক যতখানি দায়ী, তার থেকে বেশি দায়ী সরকারের নীতি। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি কিন্তু কমবেশি লাভই করে।
আমরা যদি মানুষের উত্তরণের চাকা ঘুরিয়ে দিতে না চাই, যদি গ্রামের সুদখোর মহাজনদের হাতে চিরঋণী গরিব চাষিদের আগের অবস্থায় দেখতে না চাই, যদি লালবাতি-জ্বলা ব্যাঙ্কে নিজের সারা জীবনের তিল তিল করে জমানো টাকার ধ্বংস না দেখতে চাই, তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের নীতিকে প্রশ্ন করতে হবে। গুটিকয়েক ব্যাঙ্ক কর্মচারী কিছুই করতে পারবেন না। গ্রাহকরা হল ব্যাঙ্কের ‘লাইফ লাইন’। তাই তাঁরাই কিন্তু শেষ কথা বলবেন।
মনোজ কুমার খাঁ, সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
রাষ্ট্রের বোঝা
‘যাতে দায়িত্ব না নিতে হয়?’ (৮-৩) নিবন্ধে অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর অনাদায়ি ঋণের কারণ নানা ভাবে ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, বড় কর্পোরেটদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের গাঁটছড়ার কথা। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর দফারফা করেছেন। যথার্থ বিশ্লেষণ। এ ক্ষেত্রে আরও একটি উদাহরণ যোগ করা যেতে পারে— ‘নির্বাচনী বন্ড’, যা গড়ার লক্ষ্যে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা ও দান-সংগ্রহ করার আইনকে সংশোধন করেছিল। সেই আইনে চাঁদার ঊর্ধ্বসীমা সবার কাছে প্রকাশ করারও কোনও দায় নেই। ২০১৬-২০১৭ এবং ২০১৭-২০১৮ সালের হিসেবে এ ভাবেই সংগৃহীত চাঁদা বা অনুদানের ৯২.৫% বিজেপি একাই পেয়েছিল। ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম’-এর সমীক্ষা জানাচ্ছে, ২০১৭-২০১৮ এবং ২০১৮-২০১৯ সালে মোট নির্বাচনী অনুদানের ৬০% বিজেপি একাই করায়ত্ত করে। আবার ‘সেন্টার ফর মিডিয়া সার্ভিস’-এর রিপোর্টে পাই, ২০১৯ লোকসভা ভোটে বিজেপি যত টাকা ব্যয় করেছিল, তা লোকসভা নির্বাচনের মোট খরচের ৪৫ শতাংশ। এই ভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, ধনী প্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরেটদের হাত ধরে গড়ে উঠেছে বিজেপির সুবিশাল অর্থভান্ডার। তাই প্রশ্ন উঠবে, কর্পোরেট গোষ্ঠীর পুঁজির উপর প্রশ্নাতীত আস্থার জেরেই কি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে আজ ‘রাষ্ট্রের বোঝা’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে?
পৃথ্বীশ মজুমদার, কোন্নগর, হুগলি