ঈশানী দত্ত রায়ের ‘চতুর্থের স্পর্ধাই ভরসা’ (৩১-৭) প্রবন্ধটি আশা জাগায়, ভরসা জোগায়। এ যেন দম্ভের গণতন্ত্র, তা কেন্দ্রেই হোক, বা রাজ্যে। গণতন্ত্র মানে যে জনগণের শাসন, সে কথাটাই যেন তাদের মাথায় নেই। ক্ষমতায় আসীন তারা এক-এক জন যেন প্রাচীন রাজতন্ত্রকে মনে করিয়ে দেয়। সত্যের মুখোমুখি হতে এরা ভয় পায়, তাই সত্য প্রকাশের চেষ্টা করলেই গলা টিপে ধরতে যায়। কোনও কোনও সময়ে শাসকের বিরোধিতাকে, রাষ্ট্রদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করে নির্বিচারে ইউএপিএ ধারায় নির্বাসিত করা হয়। এখন পেগাসাস স্পাইওয়্যার কাণ্ডে সারা রাজ্যে তথা দেশে প্রবল আলোড়ন। বিরোধীরা আজ এককাট্টা পেগাসাস তদন্তে। পেগাসাস আড়িপাতা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কথা মনে করিয়ে দেয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধ-সংক্রান্ত গোপন নথি, যা নাকি ‘পেন্টাগন পেপার্স’ নামে খ্যাত, প্রকাশ করার দায়ে ওয়াশিংটন পোস্ট-কে সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যায় তৎকালীন আমেরিকার সরকার।
পেন্টাগন পেপার্স-কে প্রচারের আলোয় আনা হবে কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট তর্কবিতর্ক হয়েছিল সংবাদপত্রের সর্বোচ্চ মহলে। ওই ঘটনাকে ভিত্তি করে তৈরি ছবি, দ্য পোস্ট-এ প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক বেন ব্র্যাডলি বলেছিলেন, “ওদের ক্ষমতায় লাগাম পরানোর কাজটা তো আমাদের।” আমাদের সংবিধানে গণতন্ত্রে নিজেদের ভূমিকা যথাযথ পালনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংবাদমাধ্যমকে। গণমাধ্যমের কাজ শাসকের গুণগান করা আর দোষত্রুটি ঢেকে চলা নয়। বরং, দোষগুলো যথাযথ প্রচারের আলোতে আনা চাই, যাতে গণতন্ত্র সঠিক পথে চলে। গণতন্ত্রে সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম, সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশাও অনেক।
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫১
প্রতিবাদ প্রকাশ
ঈশানী দত্ত রায় ঠিকই বলেছেন যে, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার রাষ্ট্রের প্রচেষ্টা, কিংবা আড়িপাতা— এই সবের বিরুদ্ধে আমাদেরই রুখে দাঁড়াতে হবে। অবস্থা এমন যে, প্রতিবাদ তো দূর, শুধুমাত্র সত্যি বলার অপরাধেই আতঙ্কের প্রহর গুনতে হয়। প্রতিবাদের প্রতীকী মুখ হিসেবে রক্তকরবী-র বিশু ও নন্দিনীর কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু, এখানে থামলে চলবে না। চাই মনপ্রাণসম্পন্ন মানুষের প্রতিবাদের জোয়ার। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে যদি কোনও সংবাদপত্র বা বৈদ্যুতিনমাধ্যমে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদী লেখা বা বিবৃতি প্রকাশ না করা হয়, সেটাও শাসককে সেবা বলেই মনে হয়। তাই সংবাদমাধ্যমকে নিজের ভূমিকাও পালন করতে হবে।
অশোক দাশ
রিষড়া, হুগলি
স্পর্ধা, না স্বার্থ?
সংবাদমাধ্যমের মূল আদর্শ নিরপেক্ষতা ও সত্য প্রকাশের দায়বদ্ধতা। কিন্তু কোনও এক পক্ষ নিতে গিয়ে সংবাদপত্র তার সঠিক ভূমিকা পালন থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। অপছন্দ বলেই সাদাকে জোর করে ‘কালো’ বলা, আবার কারণ ও সময় বিশেষে যথার্থ কালোকে ‘কালো’ বলা হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়াজনিত অসন্তুষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা কিন্তু ‘চতুর্থের স্পর্ধা’-র প্রকাশ বলে গণ্য হতে পারে না। যেমন— স্থানীয় শক্তির পক্ষপুটে আশ্রয়ের নিরাপত্তায় দূরবর্তী শক্তিকেন্দ্রের বিরোধিতা, কিংবা বিশেষ প্রদেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে একই সংবাদমাধ্যমের ভিন্ন রূপ ও আখ্যান, আর যা-ই হোক ‘স্পর্ধা’র সূচক নয়, বরং তা আত্মবিক্রয়ের নামান্তরমাত্র। কেন সংবাদমাধ্যমের প্রতি সাধারণের অবিশ্বাস দেখা যায়, ভাবা দরকার।
শান্তনু রায়
কলকাতা-৪৭
ঘোমটার আড়ালে
ঈশানী দত্ত রায় মাঝনদীতে দাঁড়িয়ে নদীর স্রোত পরীক্ষা করেছেন। আজকের সংবাদমাধ্যমের অবস্থা কিছুটা উনিশ শতকের বহুগামী বাবুদের মতো। তরুণ মজুমদারের সংসার সীমান্তে ছবিতে সমাজসচেতন বাবু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নিষিদ্ধ পল্লিতে ঢুকছেন মুখ ঘোমটায় ঢেকে। ক্ল্যাপস্টিক-এর মাধ্যমে খুব জোরালো বক্তব্য। আজকের সংবাদমাধ্যমের, বিশেষ করে জাতীয় স্তরে, অনেকটা এই অবগুণ্ঠিত বাবু-দশা। শাসকের পদলেহনকে ব্যবসায়িক পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে চতুর্থ স্তম্ভ (ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে)। রাজার কাপড় দেখতে পাচ্ছি না।
গৌতম চক্রবর্তী
কলকাতা-৭০
সেই সময়
‘চতুর্থের স্পর্ধাই ভরসা’ বলিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও অর্থবহ সাহিত্যের সুন্দর এক মিশ্রণ। স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পার হয়েও রাজদ্রোহ আইন রয়েই গিয়েছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বলছেন, সমাজকে সুস্থ, সবল করতে হলে গণতন্ত্রের শক্তিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে। তার জন্য সংবাদপত্রকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। এই প্রসঙ্গে একটু অতীতে যাই। আনন্দবাজার পত্রিকা যাত্রা শুরু করে ১৯২২ সালের ১৩ মার্চ, দোলযাত্রার দিনে। প্রথম সংখ্যা ছাপা হয় সমস্তটা লাল কালিতে। ব্রিটিশ সরকারের মুখপত্র ইংলিশম্যান তখন একে ‘বিপদ সঙ্কেত’ আখ্যা দেয়। পরের ইতিহাস আমরা জানি, আনন্দবাজার পত্রিকা স্বাধীনতা আন্দোলনকে নির্ভীক ও আপসহীন সাংবাদিকতার মাধ্যমে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল। এখন কি ফের সেই সময় এসেছে? লড়াইটা সহজ নয়। এক হিন্দি সংবাদপত্রের দফতরে আয়করের তল্লাশি তো আমরা দেখলাম। এর পর আছে সরকারি বিজ্ঞাপনের অস্ত্র, যা দিয়ে শাসক চতুর্থ স্তম্ভের আনুগত্য কিনে নিচ্ছে। লড়াইটা আসলে কার সঙ্গে কার, সেটা অনেক সময়
গুলিয়ে যায়।
অশোক বসু
বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
সংগঠন কই?
পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা ও বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রী প্রণব বর্ধনের আলাপচারিতা (‘কৌশল নয়, সংগঠন চাই’, ২৮-৭) স্মরণে আনল, দেশ পত্রিকায় পড়া প্রণববাবুর লেখা আত্মজৈবনিক ধারাবাহিক স্মৃতি কণ্ডূয়ন। যেখানে তিনি কেরলের এক বাম নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সমবায় আন্দোলন গড়ে সামাজিক মালিকানার প্রসারে পার্টির কোনও চেষ্টা নেই কেন? এর উত্তর ওই নেতা দিতে পারেননি। এ দেশে সম্ভবত কোনও বাম দলের কাছেই এর উত্তর নেই। আসলে প্রশ্নটাই নেই বাম রাজনীতির পাঠমালায়, পাঠশালায়। বাম দলগুলোর সামনে অনেক প্রতিপক্ষ— মালিক পক্ষ, কর্তৃপক্ষ, সরকার। শুধু নেই আপন পক্ষের উদ্যোগে, কর্তৃত্বে খামার, কারখানা, প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কর্মসূচি। নেই শ্রমজীবী থেকে যৌথ, গণ-অধিকারী হয়ে ওঠার পরিকল্পনা। বরং, গাঁধীবাদী বা অন্য দর্শনে গড়ে ওঠা সমবায় আন্দোলন থেকে কোনও শিক্ষা না নেওয়ার দৃঢ়তা আছে। অথচ, বাম সমর্থক শিক্ষক, চিকিৎসকদের সাহায্যে পিছিয়ে থাকা শ্রেণির কাছে বিকল্প ভাবনার শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতে পারত দল। সেটা যে সম্ভব, দিল্লিতে আপ দল প্রমাণ করে দিয়েছে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সুকান্ত চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধে (‘চাকরি তো হল, আর শিক্ষা?’, ১২-৭) দিল্লি সরকারের শিক্ষা প্রসারের কথা উল্লেখ করেছেন।
আপ দল দিল্লি থেকে গুজরাতের পুর নির্বাচনে, বা উত্তরাখণ্ড, পঞ্জাবে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিস্পর্ধী শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি করছে মাত্র আট বছর বয়সে। আর ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে পাশের কোনও রাজ্যে তেমন প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ হয়েছে বামেরা। এবং ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক দশকের মধ্যেই শূন্যে তলিয়ে গিয়েছে। তাই, গোলপার্কে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অতি উচ্চমানের শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র গড়ে ওঠা স্বাভাবিক, কিন্তু আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএম-এর দফতরে ওই জাতীয় কিছু গড়ে ওঠা আকাশকুসুম কল্পনা।
মানস দেব
কলকাতা-৩৬