“অপরাধীর ‘ঢাল’ হল মনোরোগ?” (২১-৭) প্রবন্ধে রত্নাবলী রায় যথার্থই বলেছেন, “...যা কিছু প্রচলিত ধারণা বা কার্যক্রমের বাইরে, তাকেই ‘পাগলামি’ তকমা দেওয়ার অপচেষ্টার শিকড় মনের গভীরে।” প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। বাঁকুড়ার কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ও শিক্ষিকা, যাঁরা ওই স্কুলের কচিকাঁচা পড়ুয়াদের বিক্রির অভিযোগে সম্প্রতি গ্রেফতার হলেন, তাঁরা তো সম্মাননীয় ব্যক্তি; কিংবা যে সমস্ত বড় মাপের ব্যবসায়ী জাল ওষুধের কারবারে যুক্ত, এবং যারা প্রতিনিয়ত খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দিয়ে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের কর্মকাণ্ডকেও কি মানসিক বিকৃতি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে!
সবিনয়ে জানতে চাই, রাজ্যের সাম্প্রতিক নির্বাচনে যে-সমস্ত দলবদলু এ-ডাল থেকে ও-ডালে লাফালাফি করে ভোটারদের বিব্রত করলেন; নির্বাচনী সমাবেশে ওই সব সুযোগসন্ধানী রাজনীতিককে ‘গদ্দার’ আখ্যা দেওয়ার পরেও যখন দেখা যাচ্ছে তাঁরা সসম্মানে পুরনো দলে আশ্রয় পেয়ে যাচ্ছেন, তখন কি আমাদের সংশয় প্রকট হবে না যে, এ সব ঘটনাও নিশ্চিত ভাবেই প্রচলিত কার্যক্রমের বাইরে? অর্থাৎ, এগুলোও এক ধরনের মানসিক অসুস্থতার নিদর্শন? আজ অতিমারি-সহ নানা কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন কর্মহীনতায়, অর্থকষ্টে ধুঁকছেন; প্রবল শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় দেশের অন্নদাতারা যখন নিদারুণ কষ্টের শিকার, ঠিক তখনও দেশে নির্মিত হয়ে চলেছে ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’ তথা বিলাসবহুল সব প্রাসাদ। অতএব আমাদের প্রচলিত ধারণার বাইরে এই যে সব আপাত ‘পাগলামি’, আমরা যদি তাকে মনোরোগ বলে চিহ্নিত করে দিই; এবং এই প্রবণতা যদি সিলমোহর পেতে থাকে, তবে বলতেই হচ্ছে, পুরো সমাজটাই আজ মনোরোগে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত
ধাড়সা, হাওড়া
মুখ ও মুখোশ
রত্নাবলী রায়ের লেখা প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত। প্রতি দিন টিভি চ্যানেলের নানা যুক্তি, মতামত শুনতে শুনতে সমাজের অসঙ্গতিপূর্ণ কার্যকলাপ, অপরাধ আর মনোরোগ সব একাকার হয়ে যেতে দেখি। অদ্ভুত ভাবে দেবাঞ্জন দেব নামের ব্যক্তিটিও মনোরোগী তকমায় জালের আড়ালে চলে যাচ্ছেন না তো? বিপুল প্রতারণা সত্ত্বেও নিরপরাধের ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছেন না তো অযৌক্তিক সহানুভূতিতে! লেখিকা দেখিয়েছেন, সত্যিকার মনোরোগী যিনি, তাঁকেও সামাজিক জটলার অমানবিকতায় প্রহারে প্রাণ হারাতে হয়েছে। শুধু কোরপান শা-ই নন, চুরি অপবাদ থেকে শুরু করে ছেলেধরা, ডাইনি সন্দেহে নির্যাতন বহু এলাকায় প্রকাশ্যে এসেছে।
দেবাঞ্জন, শুভদীপ, সনাতন এঁরা অপরাধী। এঁদের শাস্তি ত্বরান্বিত করার প্রয়াস চাই। এঁদের সঙ্গে যুক্ত বৃহত্তর অপরাধ জগৎ স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ পাক সাধারণের সামনে। ‘মনোরোগের নিরাপত্তা বলয়’ নিয়ে ঘোরাফেরা ও আড়াল খোঁজার দুরভিসন্ধিমূলক চেষ্টা দূর হওয়া চাই। গণমাধ্যমে মনস্তত্ত্ববিদদের মতামত আজকাল যে কোনও চ্যানেলে একটু বেশিই লক্ষ করা যাচ্ছে। নানা ভ্রান্ত অমূলক মতও আত্মস্থ করতে হচ্ছে দর্শককে। এ প্রসঙ্গে অম্লানকুসুম চক্রবর্তীর ‘আয় নম্বর, আয়’ (রবিবাসরীয়, ১৮-৭) গল্পের প্রাসঙ্গিক লাইন উল্লেখ করছি। এখানে গল্পের মূল চরিত্র নিজ কন্যা সন্তান জন্মালে তাকে সাইকোলজিস্ট বানানোর পরিকল্পনা করছে। কারণ, “পড়াতে খরচা কম, কিন্তু বাজারে হেব্বি ডিম্যান্ড। কাউন্সেলিং করে যা রোজগার, তার চেয়ে ঢের বেশি কামাই টিভিতে মুখ দেখিয়ে।... টিভির সন্ধেবেলার তর্কের শো’তে এক পিস মনোবিদ মাস্ট।”
যে কোনও অপরাধ, ধর্ষণ থেকে রাহাজানি, খুন থেকে প্রতারণা— সব কিছু মনোরোগ হিসেবে দেগে দেওয়ার যে অর্থহীন প্রয়াস, তার বিরুদ্ধে কথা বলারও সময় এসেছে। অনেক অপরাধ, অপরাধীর অন্তরালে চলে যাওয়া, অন্যায় ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা এ ভাবেই চলতে থাকে। মনোরোগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার না করে সত্যিকারের মুখ বেরিয়ে পড়ুক মুখোশের আড়াল থেকে।
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
নতুনপাড়া, জলপাইগুড়ি
আড়ালে যাঁরা
জাল টিকাকাণ্ডের নায়ক দেবাঞ্জন দেব ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্যে এল আরও দুই প্রতারকের নাম। ভুয়ো সিবিআই অফিসার শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আর এক জন সনাতন রায়চৌধুরী। এই রাজ্য কি প্রতারক, ঠগ ও জোচ্চোরদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র হয়ে গেল? আইএএস তকমাধারী দেবাঞ্জন শহরের দু’-দু’টি জায়গায় টিকাকরণের শিবির চালিয়ে গেলেন এবং হাজারের উপর মানুষকে ভুয়ো কোভিড টিকা দিলেন। পুরসভার যুগ্ম কমিশনারের বোর্ড গাড়িতে লাগিয়ে বেশ কিছু ব্যবসায়ীর থেকে সিকিয়োরিটি ডিপোজ়িটের নামে কয়েক লক্ষ টাকা কামিয়ে গেলেন অনায়াসে। অভিজ্ঞতা বলে যে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ও মদত ব্যতিরেকে প্রতারণার এত বড় জাল বিস্তার করা প্রায় অসম্ভব। সঙ্গত কারণেই সংবাদপত্রে উঠে এল— দেবাঞ্জন কি মনোরোগী? একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কণ্ঠে। অবাক লাগে। আদালতে যদি দেবাঞ্জনকে মনোরোগী প্রতিপন্ন করা যায়, তবে তাঁর জবানবন্দি থেকে তো আর কাউকে অভিযুক্ত করা যায় না। রাজনীতির কেষ্ট, বিষ্টুরা অন্তরালেই থেকে যাবেন।
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫১
এখনও আঁধার
সোনালী দত্তের ‘দেবী নয়, মানুষ হওয়া চাই’ (১৫-৭) প্রবন্ধটি পড়ে ঋদ্ধ হলাম। এই প্রসঙ্গে কিছু বলার জন্য এই চিঠি। এখনও মেয়েদের বাল্যবিবাহ হয় এবং তার দায় তাকে নিতে হয়। অপরিণত বয়সে সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর দুর্বল শরীরে লাথি, ঝাঁটা খেতে খেতে সংসারের সব দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়। কত স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ের ঠাঁই হয়নি বাপের ঘরেও। ধর্ষণের পর মেরে ফেলা, পুড়িয়ে ফেলার ঘটনাও অনেক। অ্যাসিড ছুড়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মুখ, শরীর। বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতায় ন্যায়বিচার পেতে সময় গড়িয়ে যায়। অনেকে আর্থিক অসুবিধার জন্য বিচারালয়ে যেতে পারেন না। গ্রামে-গঞ্জে হিন্দু ব্রাহ্মণ বিধবাদের এখনও কঠিন নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা এ কোন গহন অন্ধকারে পড়ে আছি!
আমার এক খুড়তুতো দেওর নার্ভের অসুখে দীর্ঘ দিন শয্যাশায়ী। তিন সন্তানের জননী তাঁর স্ত্রী একা হাতে স্বামীর চিকিৎসা, সেবা, ছেলে-মেয়েদের মানুষ করা এবং সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করছেন। এ জন্য তাঁকে সমাজ-সংসারের কিছু নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে স্বাধিকার অর্জন করতে হয়েছে। প্রয়োজনে আমাদের বাড়ির মেয়েরাই যে এই ভূমিকা পালন করতে পারে, তা আমাদের চোখে পড়ে না। বরং, আমরা ব্যস্ত থাকি তার ভুল-ত্রুটি ধরতে, তার সমালোচনা করতে।
মেয়েদের সেনাবাহিনীতে সমান মর্যাদা পাওয়ার জন্য দীর্ঘ আইনি লড়াই করে তা অর্জন করতে হয়। অথচ, এঁদের যে কোনও কাজের প্রতি নিষ্ঠা, পরিশ্রম, ত্যাগ— অনুকরণ যোগ্য। সব কিছু ঠিক থাকলে নাসার কনিষ্ঠতম সদস্য কুড়ি বছরের এলিজা কার্সন ২০৩৩ সালে মঙ্গল গ্রহে যাবেন। হয়তো আর পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবেন না। বিরাট ত্যাগের নিদর্শন। স্কুলছাত্রী সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ এখন আন্তর্জাতিক পরিবেশ আন্দোলনের পরিচিত মুখ।
একবিংশ শতকের নারীরা সব ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা অতি সামান্য। আমাদের দেশ তথা রাজ্যের মেয়েদের সে সুযোগ কোথায়! পুরুষশাসিত সমাজে শিক্ষায়, কাজের জায়গায়, দেশ শাসনে মেয়েদের সমানাধিকারের সুযোগ এখনও নেই। নারীদের ক্ষমতা, অধিকারবোধ সম্পর্কে সচেতন করতে পারলে তবেই একমাত্র নারীশক্তির জাগরণ সম্ভব হবে।
মহাশ্বেতা দাস পতি
তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর