Society

সম্পাদক সমীপেষু: পাশে থাকা

রাষ্ট্রের পক্ষে এই কাজটা আর একটু সহজ হবে যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দান-ধ্যানের ক্ষেত্রটা নির্বাচন করা হয় নিকটজনের পরিসরে। নিকটজন বলতে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতজন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৩ ০৪:৫৭
Share:

নিকটজন বলতে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতজন। প্রতীকী ছবি।

‘অন্যের উপকার করব কেন’ (১১-৩) এই প্রশ্নের উত্তর জানলে নাগরিককে আরও অনেক দায়িত্বশীল ও বিবেচক করে তোলার কাজটা রাষ্ট্রের পক্ষে সহজ হয়, তাই ইন্দ্রজিৎ রায় তাঁর প্রবন্ধে উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। বিশুদ্ধ পরহিতৈষণা সোনার পাথরবাটি, আবার পরহিত করেও ভবিষ্যতে লাভ অনিশ্চিত— এই নিয়ে আলোচনার পরেও তিনি দু’টি পথের কথা বলেছেন। ব্যক্তিগত ভাল লাগা বা নীতিবোধ, আর সামগ্রিক চিন্তাভাবনা, যাকে ধারণ করে আছে পারস্পরিক সাহায্যের আশ্বাস বা ধর্মের বিশ্বাস। যদিও স্থান-কালের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাপারটাও রয়েছে।

Advertisement

রাষ্ট্রের পক্ষে এই কাজটা আর একটু সহজ হবে যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দান-ধ্যানের ক্ষেত্রটা নির্বাচন করা হয় নিকটজনের পরিসরে। নিকটজন বলতে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতজন। এমনিতেই একটা আত্মিক টান এ-ক্ষেত্রে থাকে, তাই ‘পাশে থাকা’ অনেকটা সহজ হয়। আত্মিক টান থেকে দায়িত্ববোধও আসে। ফলে নিয়মিত, কিংবা প্রয়োজনমতো সাহায্য করার একটা মনোভাবও থাকে। তাতে সাহায্যপ্রার্থীর একটা যথার্থ লাভ হয়। অতীতের গ্রামসমাজে এমনটা দেখা যেত।

তাই যে পরিস্থিতিতে মানুষ দানপরায়ণ হয়, সেই পরিস্থিতি নিকটজনের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত সহজে সৃষ্টি করা সম্ভব। কেননা নিকটজনের প্রত্যাশা দাতাকে তুলনায় বেশি উৎসাহিত করতে সাহায্য করবে। তখন সেই দাতাকে আরও একটু মদত দেওয়া রাষ্ট্রের পক্ষে সহজ হওয়ার কথা।

Advertisement

আর অনেকেই যদি সামর্থ্য মতো শুধু নিকটজনের পরিসরেও কাজটা করে যায়, সেটাও কম হবে না। তবে সমস্যাও আছে। নিকটজনের প্রত্যাশা বেশি হয়। দাতার সাহায্য তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে নিকটজনের কাছে হাত পাতা নিয়ে হীনম্মন্যতার সৃষ্টি হতে পারে। যা থেকে একটা বিরোধের ক্ষেত্রও তৈরি হতে পারে। তবে যাদের সাহায্যের একান্ত দরকার তারা বিরোধিতার দিকে যাবে না।

দুর্গেশ কুমার পান্ডা, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

বিদ্যাসাগর

ইন্দ্রজিৎ রায় দান সম্পর্কে লিখেছেন, কিন্তু দানবীর বিদ্যাসাগরের কথা লেখেননি। বিদ্যাসাগর সব সময় বলতেন, ডান হাতে কেউ দান করলে সে কথা যেন তার বাম হাত না জানতে পারে। বিদ্যাসাগরের দান সব সময় কিছু পাওয়ার আশা না করেই দান। তবে বেদোক্ত দান অন্য রকম। ‘শ্রিয়া দেয়ম্ হ্রিয়া দেয়ম্’ সর্বশেষে ‘সংবিদা দেয়ম্’। দান করার আগে যাঁকে দান করছেন, তাঁর কথা জানতে হবে।

সঞ্জয় চৌধুরী, কেষ্টপুর, কলকাতা

ভক্তির মার

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সর্বমঙ্গলের বিজ্ঞান?’ (১০-৩) লেখাটি আবার উস্কে দিল প্রাচীন হিন্দু ভারতের এক অলীক ইতিহাস রচনা। এই বছরের জাতীয় বিজ্ঞান দিবসের থিম ‘গ্লোবাল সায়েন্স ফর গ্লোবাল ওয়েলবিয়িং’ শুনতে যতই গালভরা হোক না কেন, ইদানীং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা বাড়ানোর নামে যে ভাবে অপবিজ্ঞানের লাগামছাড়া প্রচার চলছে, সেটা শুধুই হাস্যকর নয়, কুরুচিপূর্ণ ও ঘোরতর অন্যায়। বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। ছাত্রছাত্রীদের এখন নাকি শিখতে হবে ‘মেডিক্যাল অ্যাস্ট্রোলজি’, মনুস্মৃতি এবং মানতে হবে কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে অনুলোম-বিলোমের মিল।

হিন্দুরাষ্ট্র নামক এই বৃন্দসঙ্গীত শুরু হয়েছে কিন্তু কয়েক বছর আগে থেকেই। হিন্দু সভ্যতা কত প্রাচীন ও উন্নত ছিল সেটা প্রমাণ করার জন্য কল্পকাহিনি-ভিত্তিক অবাস্তব দাবি করা শুরু হয়েছে। আজ থেকে সাত-আট বছর আগে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের ১০২তম সম্মেলনে জনৈক ক্যাপ্টেন আনন্দবর দাস বলেছিলেন— বৈদিক যুগে চল্লিশটি ইঞ্জিনযুক্ত ২০০ ফুট লম্বা বিমান তৈরি হয়েছিল, যেটা যাতায়াত করত গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। এটা সাত হাজার বছর আগে আবিষ্কার করেছিলেন মহর্ষি ভরদ্বাজ। আর এক জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেছিলেন, পাইথাগোরাসের ৩০০ বছর আগেই তাঁর সব আবিষ্কার প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক বৌধায়ন তাঁর সূত্রগুলিতে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।

দুঃখের বিষয়, এই সব কল্পকাহিনির ঢক্কানিনাদের আড়ালে প্রাচীন ভারতের প্রকৃত গরিমা কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে। লেখিকা যথার্থই বলেছেন যে, প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চা নিয়ে স্পষ্ট ও প্রামাণ্য বিষয় তুলে ধরা আমাদের উচিত।

হিন্দুত্ব যে একটি সুপ্রাচীন সভ্যতার নাম, সে তো আমরা সবাই জানি। ব্যাবিলনীয় ও সুমেরীয়দের মতো হিন্দুরাও যে ছিলেন নানা বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী, এই তথ্য প্রায় সকলেরই জানা। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল— ৫০০ খ্রিস্টাব্দের আগে কোনও এক সময় ভারতের শূন্য (০) আবিষ্কার, স্থানিক মান এবং তার সাহায্যে অতি সহজে যে কোনও সংখ্যা লেখার কৌশল উদ্ভাবন। শূন্যের মতো সংখ্যা বা চিহ্নের আবিষ্কার কী অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ, কতখানি বৈপ্লবিক, তা বোঝাতে আমেরিকার লরেন্স বার্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি-র গণিত গবেষক ডেভিড বেইলি এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের জোনাথন বরওয়েন উল্লেখ করেছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি গণিতজ্ঞ পিয়ের সিমোঁ লাপ্লাস ও গণিতের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জর্জ ইফ্রার মন্তব্য, যাঁদের মতে এই উদ্ভাবন আগুন আবিষ্কারের চাইতে কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পদার্থ কণা গবেষণায় নোবেল বিজয়ী আমেরিকার বিজ্ঞানী ডেভিড গ্রস কয়েক বছর আগে এক বার কলকাতায় এসে তাঁর ভাষণে জানতে চেয়েছিলেন, “যে দেশ শূন্যের মতো গভীর তাৎপর্যপূর্ণ একটা ধারণার জন্ম দিয়েছিল, সে দেশে বিজ্ঞান গবেষণা পরবর্তী কালে জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করেনি কেন? কোন কারণে মধ্যযুগে ভারত পিছিয়ে পড়েছিল?”

প্রবন্ধকার এক জায়গায় লিখেছেন, বিজ্ঞান দিবস পালনের মৌলিক উদ্দেশ্য (ছিল) সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার বিকাশ ঘটানো। বাস্তবে তা ঘটছে কই? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে। আমাদের হাত ধরে নিত্যনতুন চমকের যে বর্ণাঢ্য জগতে পৌঁছে দিচ্ছে, তা অবিশ্বাস্য। কিন্তু চোখধাঁধানো এই আলোর নীচেই গভীর অন্ধকার। আমাদের মন পড়ে আছে এক ফ্যান্টাসি ও গভীরতর কুসংস্কারের জগতে। বিজ্ঞানমনস্ক আমরা হতে পারিনি। যে স্মার্ট যুবকটি আধুনিকতম মোবাইল হাতে নিয়ে কথা বলছে, তার চার আঙুলে শোভা পাচ্ছে চারটি বিশেষ ধাতব আংটি, সেটা দেখে কি মনে হয় না যে, আমাদের চেতনা একই জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে আছে? কলেজে কলেজে বিজ্ঞান প্রদর্শনী, বিজ্ঞান-মঞ্চ সবই আছে, কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের জীবনে যুক্তিবাদ আনতে তো পারছেই না, বরং ধর্মীয় কুসংস্কারগুলিকে আজও আমরা আঁকড়ে ধরে আছি। তাই পাড়ায় পাড়ায় হরেক পুজো, জ্যোতিষচর্চা, শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য মানুষের উন্মাদনা। মাথা চাড়া দিচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদ। ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় উন্মাদনার পরিবেশে হাজার হাজার গুরু, অবতার, পিরবাবা, লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে গ্রহদের নিজের সুবিধামতো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পাথরের ব্যবসার রমরমা ইত্যাদি নদীর স্রোতের মতো বহমান। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার মতে, এই সব ‘ডেঞ্জারাস ননসেন্স’ বন্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তাই আমাদের জীবনচর্চার অভ্যন্তরে বিজ্ঞানমনস্কতার জায়গা তৈরি হয়নি। অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের শিকল একটুও শিথিল হয়নি।

বেশির ভাগ মানুষ কর্মফল, পরলোক, জন্মান্তর এবং পবিত্র আত্মার অতীন্দ্রিয় জগতে বাস করতে ভালবাসেন। তা শুধুই আবেগতাড়িত, কোনও রকম যুক্তিই সেখানে কাজ করে না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “সে ধর্ম বিষকন্যার মতো; আলিঙ্গন ক’রে সে মুগ্ধ ক’রে, মুগ্ধ ক’রে সে মারে। শক্তিশেলের চেয়ে ভক্তিশেল গভীরতর মর্মে গিয়ে প্রবেশ করে, কেননা তার মার আরামের মার।”

অনিলেশ গোস্বামী, শ্রীরামপুর, হুগলি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement