ঈশানী দত্ত রায় ‘স্পর্শের প্রতিস্পর্ধা’ (২৮-৩) নিবন্ধে লিখেছেন, “করোনাকালে, ভুয়ো খবর বা প্রচারের যুগে, সংবাদপত্র আরও বেশি নির্ভরযোগ্য সংবাদ উৎস হয়ে উঠেছে।” মনে এল শেক্সপিয়রের হেনরি দ্য ফোর্থ নাটকের কথা, যেখানে ‘গুজব’ নিজের চরিত্রের বর্ণনায় বলে, “হাওয়া আমার ঘোড়া যাতে চড়ে আমি পুবের প্রান্ত থেকে পশ্চিমের দিকচক্রবাল পর্যন্ত ঘুরে বেড়াই, বর্ণনা করি পৃথিবীর সমস্ত ঘটনা। আমি সারা ক্ষণ সব ভাষায় মিথ্যার বিষে পূর্ণ করি মানুষের কান।” পাঠকের ‘অখণ্ড আস্থা’কে সত্যের স্পর্শ দেওয়ার লক্ষ্যে আজও সমান গতিশীল আনন্দবাজার পত্রিকা।
শতবর্ষ পেরিয়ে আজ এ নিছক খবরের কাগজ নয়। বাঙালির রুচি, আভিজাত্য ও মননচর্চার এই মুদ্রিত অভিজ্ঞানে বাঁধা পড়েছে ভাষার উৎকর্ষ, সত্যনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ, সর্বোপরি অকুতোভয় সাংবাদিকতার এক অনন্য নজির। পরিমার্জিত শুদ্ধ বানানবিধি ও নিজস্ব শৈলীজাত বিশেষ শব্দবন্ধ প্রয়োগে এই দৈনিক প্রতি দিন পাঠকের সামনে সৃজনশীলতার ছাপ রেখে যায়। আমার বিশেষ পছন্দ প্রথম পাতার অননুকরণীয় শিরোনাম। অমর্ত্য সেনের নোবেল প্রাপ্তির পর দিন, ‘মর্তের সেরা সম্মান বাংলার অমর্ত্যের’ (১৫ অক্টোবর, ১৯৯৮), পাক হানাদার খতম করতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর, ‘টাইগার হিলে ফের ভারত-সূর্য’ (৫ জুলাই, ১৯৯৯), নেপালে মত্ত যুবরাজের গুলিতে পারিবারিক হত্যার পরে, ‘যত কাণ্ড সেই কাঠমান্ডুতেই’ (৩ জুন, ২০০১), নোবেল পদক হারানোর খবরে, ‘চুরি হয়ে গেছে রবিকোষে’ (২৬ মার্চ, ২০০৪)। বামফ্রন্ট সরকারের পতনের পর দিন সংক্ষিপ্ত, অথচ গভীর ব্যঞ্জনাপূর্ণ শিরোনাম প্রকাশিত হল, ‘বাম বিদায়’ (১৪ মে, ২০১১)। মাদার টেরিজ়ার সন্ত স্বীকৃতি প্রাপ্তির পর লেখা হল, ‘জননী সন্তভূমিশ্চ’ (৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)।
এই অনুষঙ্গে মনে এল অভিশপ্ত সেই বিকেলের কথা (৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯), যে দিন আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করেছিল আনন্দবাজার দফতরকে। বিভীষিকার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে পর দিন যথারীতি এই কাগজ পাঠকের কাছে পৌঁছে গেল। বিশেষ সম্পাদকীয় নিবন্ধে (‘পুড়িয়াও যাহা পোড়ে না’) লেখা হল, “নিজস্ব ভবনের বাহিরে সাময়িক আস্তানায় বসিয়া তাঁহারা শনিবারের কাগজ পাঠকদের হাতে তুলিয়া দিবার জন্য কাজ করিয়া গিয়াছেন। এ কাজে সমস্যার অন্ত ছিল না। কিন্তু সব সমস্যাকে অগ্রাহ্য করিয়া, সব অসুবিধাকে তুচ্ছ করিয়া তাঁহারা সংকল্পে অবিচল ছিলেন। তাহার প্রমাণ শনিবারের এই কাগজ।” বৃহদারণ্য বনস্পতিসম আনন্দবাজার পত্রিকা বাঙালির মননচর্চাকে সমৃদ্ধ করুক, শতবর্ষে এই কামনা করি।
সুপ্রতিম প্রামাণিক, আমোদপুর, বীরভূম
খেলার পাতা
শতবর্ষে আনন্দবাজার পত্রিকা-র পদার্পণ উপলক্ষে প্রকাশিত ক্রোড়পত্র একটি ছোটখাটো স্মারক গ্রন্থ। আনন্দবাজার পত্রিকা-র সঙ্গে প্রথম পরিচয় ষাটের দশকে। তখন আসানসোলে রেলওয়ে ট্র্যাফিক কোয়ার্টারে থাকতাম। বেলা একটা নাগাদ ডেলিভারি ম্যান কাগজ দিতেন। পরনে খাকি পোশাক। বুক পকেটে পিতলের আইডেন্টিফিকেশন নম্বর প্লেট ঝুলত। সাইকেলের রডে একটা টিনের প্লেট। লাল কালিতে লেখা ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’।
তখন সবার বাড়িতে রেডিয়ো ছিল না। তাই কাগজের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। আগের দিন কোনও বড় ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা থাকলে খেলার পাতা নিয়ে মারামারি লেগে যেত। তখন আনন্দবাজার পত্রিকা-র সঙ্গে যুগান্তর, কালান্তর, বসুমতী, অমৃতবাজার ইত্যাদি কাগজও বিক্রি হত। তখনও এই পত্রিকার জনপ্রিয়তা ছিল সবার শীর্ষে, এখনও যেমন।
তপন কুমার মুখোপাধ্যায়, সুভাষ পল্লি, বর্ধমান
ভাষার বিবর্তন
শতবর্ষে পদার্পণ করা আনন্দবাজার পত্রিকা-প্রকাশিত ক্রোড়পত্রটি অসাধারণ। নিরপেক্ষ খবর পরিবেশনই শুধু নয়, সময়ের ব্যবধানে এই পত্রিকার বিবর্তনের ধারাটিও অব্যাহত ও বিজ্ঞানসম্মত। ভাষা-বিবর্তন তারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথও কথ্য ভাষার পক্ষপাতী ছিলেন। বানান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “মূল শব্দটিকে স্মরণ করাইবার জন্য ধ্বনির সহিত বানানের বিরোধ ঘটানো কর্তব্য নহে।” ধ্বনি-বানানের বিরোধে ‘কলকাতা’ হয় ‘ক্যালকাটা’, ‘ঠাকুর’ হয় ‘টেগোর’, কিংবা ‘দত্ত’ হয়ে যায় ‘ডট’। আবার ধ্বনির সঙ্গে বানানের বিরোধ মেটাতে ‘শচিন’ থেকে ‘সচিন’, ‘গান্ধী’ থেকে ‘গাঁধী’, কিংবা ‘পৌরসভা’ ‘পুরসভা’ হয়েছে। ‘বন্ধনহীন গ্রন্থি’-র তত্ত্ব মানতে গিয়ে দপ্তর দফতর হয়েছে।
কী লিখবেন, কেন লিখবেন শীর্ষক বাংলা শব্দের বানানরীতি বিষয়ক বইয়ের সম্পাদক ছিলেন শ্রদ্ধেয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, যিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘বানান সমিতি’-রও সদস্য ছিলেন। অাকাদেমি প্রকাশিত বানান অভিধানের সঙ্গে এই বইয়ের তুলনা করলে মনে হয়, সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের ভাষা ভিন্ন। যদিও ‘ভাষা যেন পাঠকের মন স্পর্শ করতে পারে’ (ক্রোড়পত্র, ২৮-৩) নিবন্ধে লেখা হয়েছে, “ভাষা ব্যাকরণনির্ভর অবশ্যই, কিন্তু নিছক ব্যাকরণ নয়। তার মনও আছে। সে মন কামনা-ক্রোধ, হাসি-কান্না, প্রতিবাদ-আনুগত্য সব ভাবেরই কায়া-কাঠামো।” নিবন্ধকার আরও লিখেছেন, “প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক প্রফুল্ল কুমার সরকারের ভাবনা ছিল ব্যতিক্রমী। সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর সখ্য আর চর্চার কথা সুবিদিত।” এই সখ্যই বুঝি ভবিষ্যতের ভাষা-বিবর্তনের অনুপ্রেরণা। শুষ্ক, রুক্ষ সংবাদকে ভাষা-মোড়কে, সাহিত্য-রসে জারিত করে তুলে ধরার প্রয়াস। প্রায় দু’দশক আগে রাজ্য সরকারি স্তরে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারে ইংরেজি শব্দসমূহের পরিভাষা সংক্রান্ত একটা বই প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সরকারি দফতরে বাংলা ভাষা আজও তেমন মর্যাদা পায়নি। এহেন অবস্থায় সাংবাদিকতার মোড়কে হলেও বাংলা ভাষাকে বাঙালির নিজের ভাষা ভাবার মহান দায়িত্ব নিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। পরিশেষে প্রস্তাব— একশো বছর ধরে পথ চলার ইতিহাসে এই পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখা শুরু হোক চলিত ভাষায়।
অমরেশ পাল, সাহাগঞ্জ, হুগলি
পড়তে চাই
একশো বছরের আনন্দবাজার পত্রিকা কী দিতে পারে তার পাঠকদের? সযত্নরক্ষিত তথ্যভান্ডার। পাঠক হিসেবে আমি পড়তে উৎসাহী পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের গত একশো বছরের বিশেষ বিশেষ, ধরা যাক, দু’শো দিনের কাগজ। আমি চাই, বাড়ির কম্পিউটারে বসে সেই তথ্য পড়তে, দেখতে এবং প্রয়োজনে ব্যবহারও করতে। আজকের যুগে অসম্ভব একেবারেই নয়। রিচার্ড স্টলম্যান বলেছিলেন— বিশ্বাস করি, সমস্ত দরকারি তথ্য ফ্রি-তে পাওয়া উচিত। এখানে ফ্রি বলতে আমি মূল্যের কথা একেবারেই বলছি না। সেই স্বাধীনতার কথা বলছি, যা সেই তথ্য জানতে, বুঝতে, শিখতে, টুকে রাখতে এবং প্রয়োজনে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বাধীনতা দেবে। তথ্য যখন সাধারণ ভাবে দরকারি, তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার অর্থ মানবতাকে সমৃদ্ধ করা।
এক জন আগ্রহী পাঠক হিসেবে আমি জানতে এবং পড়ে দেখতে চাই, সুভাষচন্দ্র বসুর গৃহত্যাগের পর দিন আনন্দবাজার পত্রিকা-য় কী লেখা হয়েছিল। এই জানতে চাওয়াটাও আমার অধিকারের মধ্যেই পড়ে। আমি এই পরিষেবা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ দিতে আগ্রহী। কিন্তু উপায় নেই। তথ্যভান্ডারে তালা!
সেই তালা কি খুলে দেওয়া যায়? ধরা যাক, এক বছরের পুরনো প্রতি দিনের কাগজ দেখার জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ধার্য করে? পাঠক নিজের মতো করে দেখে নেবে। ব্যবসায়িক স্বার্থও দেখা হল, পাঠকের স্বার্থও।
কাশীনাথ ভট্টাচার্য, কলকাতা-৫৬