অমর্ত্য সেন। —ফাইল চিত্র।
ইতিহাসবিদ রজত কান্ত রায় লিখিত ‘কোন ভারত, প্রশ্ন এটাই’ (৭-৮) পড়ে ঋদ্ধ হলাম। তাঁর ‘কোন ভারত’ সম্পর্কিত মূল্যবান প্রশ্ন আমাদের সকলের। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও যে সীমাহীন দারিদ্র, বেকারত্ব, অপুষ্টি, অশিক্ষা আর সামাজিক অসাম্য মারাত্মক রূপে বর্তমান, তা আমাদের মোটেই কাম্য ছিল না। অবাঞ্ছিত ছিল শাসকের গণতন্ত্র পুজোর কপটতা। নতুন সংসদ ভবনে প্রবেশের আগে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম, অথচ সেই সংসদকেই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন। ধর্মনিরপেক্ষতাকে সুকৌশলে টুঁটি টিপে হত্যা করা কখনও শেখাননি গান্ধী, সুভাষের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামী। আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্প্রীতি ও সমন্বয়ের। কবীর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, গান্ধী, লালন ফকির প্রমুখ আমাদের সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
তারই বাহক অমর্ত্য সেন। অমর্ত্য রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের মেডেল চুরি যাওয়াকে গুরুত্ব দেননি। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তাঁর অভিমত ছিল, দেখতে হবে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ আমরা কতটা ধরে রাখছি। তিনি বরাবর স্পষ্টবাদী, বর্তমান দেশের শাসকের সাম্প্রদায়িক বিভাজন নীতির বিরুদ্ধে সরব। তাঁর লেখা আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স বইয়ে সে কথাই তিনি জানিয়েছেন। দি আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান গ্রন্থে অমর্ত্য জানিয়েছেন, ভারতের সমাজে কী ধরনের বাক্স্বাধীনতা এবং যুক্তিবাদের অনুশীলন বিদ্যমান ছিল। আজ রাজনৈতিক অসিহষ্ণুতার ফলে তা অবলুপ্ত।
আশঙ্কা হয়, এই সব কারণেই হয়তো কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্বভারতীর মাধ্যমে তাঁকে অবমানিত করার হীন চক্রান্তে নেমে পড়েছে। বিরোধটা আসলে জমির নয়। বিরোধ, আদর্শের ভূমির।
শান্তি প্রামাণিক, উলুবেড়িয়া, হাওড়া
সুবিধাবাদী
রঞ্জিত শূরের প্রবন্ধের (‘নীতিপুলিশি চলছে, চলবে?’ ২-৮) সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হয়েও তাঁর তোলা প্রশ্নের উত্তরগুলো অন্য ভাবে খুঁজলাম। নিরাপদ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ক্যামেরার সামনে গোমাংস ভক্ষণে উদ্গ্রীব এই বঙ্গের হাঁসজারু বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু নীরব থাকেন দেশের বা রাজ্যের সাম্প্রতিক নানা ঘটনার ক্ষেত্রে। কেউ বলবেন, দেশ জুড়ে সঙ্ঘ পরিবার আর বিজেপির সামাজিক রাজনৈতিক দর্শনের কাছে আমরা হয়তো আত্মসমর্পণ করেছি, বা করতে বাধ্য হয়েছি। রাজ্য প্রশাসনের নরম হিন্দুত্বের দোহাইও কেউ দেবেন। পিতৃতন্ত্রের বেশ কিছু প্রভাবও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই বঙ্গে বাম মানসিকতা ও যুক্তিবাদী ভাবনার বিপরীতমুখী প্রবণতা কী ভাবে এত জোরালো হচ্ছে? না কি আমাদের মনে এই অন্ধকার আগেই জমে ছিল? গ্রামের স্কুলের ছাত্ররা যখন নিম্নবর্ণের মহিলাদের রান্না করা মিড-ডে মিল খেতে অস্বীকার করে, তখন ভাবতে হবে সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। সত্তরের দশকের পরবর্তী সময়ে এই বাঁকটা বাঙালি সমাজে দেখা দিল। তখন মসনদে বামপন্থীরা। রাজনীতির মতাদর্শ চলে গেল পিছনে, সামনে এল ক্ষমতাতন্ত্র আর সুবিধাবাদ। ঈশ্বরবিশ্বাসী বাঙালিকে পাওয়া গেল সন্ধ্যায় পার্টি অফিসে, আর রবিবারের ব্রিগেডের ভিড়ে। নতুন এক সামাজিক সমীকরণ, সুবিধাবাদী সহাবস্থান। শুরু হল ব্যক্তি মানুষের নৈতিক অধঃপতন। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির সঙ্গে সুবিধাবাদ তৈরি করল এক বিষাক্ত পরিবেশের, যার উত্তরসূরিরা আজ ছড়িয়ে রয়েছে বঙ্গ সমাজের সর্বত্র। আজ নীতিপুলিশির খবরদারি ও সুশীল সমাজের নীরবতার যে ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছে, তার সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল বহু আগেই।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১৬৩
পাটের সঙ্কট
এ বছর পাট চাষের পর থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টির খামখেয়ালিপনা। সময়মাফিক বৃষ্টি না হওয়াতে পাটের আঁশ পরিপুষ্ট হয়নি। একটা সময় তীব্র রোদে পাট গাছের মাথার দিকের অংশটা শুকিয়ে যাচ্ছিল। এই রাজ্যে উত্তরবঙ্গের দিকে ভারী বৃষ্টিপাত হলেও বৃষ্টিপাতের চরম ঘাটতি রয়েছে সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে। ভরা শ্রাবণ মাসে বর্ষার স্বাভাবিক বৃষ্টি না হওয়াতে খেতেই শুকিয়ে যাচ্ছে পাটগাছ। প্রচণ্ড উত্তাপে পুকুর-ডোবা, খাল-বিল জলশূন্য।
এ দিকে পাট কাটার সময় হয়ে যাওয়াতে শ্যালো মেশিনে জল তুলে নিচু জমিতে, পুকুর জলাশয়ে জল ভর্তি করে পাট জাক দিতে হচ্ছে। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুর, নদিয়া, দুই ২৪ পরগনা, সর্বত্র পাটচাষিরা এ ভাবেই পাট পচাতে শুরু করেছেন। ফলে চাষিদের খরচ বেড়ে গিয়েছে। বৃষ্টি হলে জমির নিকটবর্তী জলাশয়ে পাট জাক দেওয়া হত। সে ক্ষেত্রে পাট বওয়ার খরচ খুব একটা হত না। বৃষ্টি না হওয়াতে চাষিদের দূরবর্তী পুকুরে পাট বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে, তাতে খরচ লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
পাট নিয়ে বছরের পর বছর এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। চাষিরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রমে পাটচাষ করেন। কিন্তু পাটের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সরকার কোনও কার্যকর ভূমিকা নেয় না। অথচ, দালাল, আড়তদাররা সেই পাট চাষিদের কাছ থেকে অল্প দামে কিনে গুদামে মজুত করে, বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ভাল দামে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। তাঁদের পাটের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠছে। কেবল চাষিরাই ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চাষিদের সমস্যার কোনও সদর্থক সমাধানের পরিকল্পনা হচ্ছে না, হলেও তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটছে না। পাটের ন্যায্য মূল্য যাতে পাটচাষিরা পান, এবং প্লাস্টিক বর্জন করে পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার যাতে বাজারে আরও বেশি হয়, তার জন্য সরকারকে ব্যবস্থা করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের পাটচাষিদের প্রতি এই বঞ্চনা, শোষণ আর কত দিন চলবে?
পাভেল আমান, হরিহরপাড়া, মুর্শিদাবাদ
বর্জ্যের ব্যবস্থা
পঞ্চায়েতগুলির নতুন বোর্ড গঠন হচ্ছে। নতুন পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের কাছে একটি উপেক্ষিত বিষয় উত্থাপন করে রাখতে চাই, সেটি হল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বর্জ্যের ক্ষতিকারক প্রভাব হ্রাস করা, এবং কিছু বর্জ্য পদার্থকে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য। অধিকাংশ পুরসংস্থা কতকগুলি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে এই কাজ করে থাকে, যেমন গৃহস্থালি, ব্যবসা ও শিল্প কেন্দ্র থেকে আবর্জনা সংগ্রহ, সেগুলি নির্দিষ্ট স্থানে বহন করা, জমা করা ও সেই স্থান রক্ষণাবেক্ষণ। পচনশীল নয়, এমন আবর্জনা পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা, বা বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুড়িয়ে নষ্ট করাও এই ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ পঞ্চায়েত এলাকায় এই ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করা হয় না। জীববিশ্লেষ্য বর্জ্যগুলি অতটা ক্ষতিকর না হলেও, অবিশ্লেষ্য কঠিন বর্জ্য কিন্তু আগামী দিনে গ্রামবাংলার পরিবেশকে ভয়ানক বিপদে ফেলতে পারে। অথচ মানুষের বাসস্থানে, বাজারে প্রতি দিন কিছু অবশিষ্ট উপাদান তো সৃষ্টি হবেই, সবার বাড়ির সামনে সেগুলি ফেলার স্থান না-ও থাকতে পারে। সরস্বতীর মতো প্রাণবন্ত এক নদীর আবর্জনাময় দশা পরিবেশ ভাবনার গোড়াটাকেই নাড়িয়ে দেয়।
গ্রামেগঞ্জের ইলেকট্রনিক্স ও মেডিক্যাল স্টোরগুলি থেকে নির্গত টন টন বর্জ্য কোথায় ফেলা হয়? পুকুর ডোবা কিংবা নয়ানজুলিতে ফেললে সেগুলি জলকে দূষিত করে মাছের মাধ্যমে পুনরায় ফিরে আসতে পারে মানবশরীরে। এমনিতেই বিজ্ঞানীরা মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাই শুধু শৌচালয় নির্মাণই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন গ্রামেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রসার ঘটানো, ভরাটকরণ বা ল্যান্ডফিল পদ্ধতিতে আবর্জনা নিষ্কাশন। সরকারি খাস জমিতে এই ব্যবস্থা করা যেতেই পারে, কিন্তু সরকারি জমি না থাকলে পঞ্চায়েতের উদ্যোগে মানুষের ব্যক্তিগত পড়ে থাকা অব্যবহার্য জমি সরকারি ভাবে উপযুক্ত মূল্যে নিয়েও এই কাজ করা যেতে পারে।
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়, জগৎবল্লভপুর, হাওড়া