মোহিত রায়ের ‘না, আপনার স্থান হবে না’ (১-১২) শিরোনামের লেখাটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে এবং শহিদদের অমর্যাদা করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “আপনার স্বদেশ বাংলাদেশের ছাত্র-যুবরা এই মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩’তে ঢাকার শাহবাগে শুরু করল এক ঐতিহাসিক আন্দোলন, যার মূল দাবি: ১৯৭১-এর গণহত্যাকারী নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। এই গণহত্যা আদতে বাঙালি হিন্দু গণহত্যা। কয়েক লক্ষ নিহতের ৯০ শতাংশ ছিলেন হিন্দু। নিহত মুসলমানরা ছিলেন মূলত আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত, যাঁদের নিধনকে রাজনৈতিক হত্যা বলা যায়।” মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সকল ধর্ম-বর্ণ, পেশা ও শ্রেণির মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে বাঙালি হিন্দু হত্যা হিসেবে আখ্যা দেওয়ায় অন্য ধর্মের শহিদদের অসম্মান করা হয়েছে।
গণহত্যায় নিহতদের ৯০ ভাগই হিন্দু— তথ্যটিও একেবারে ভুল। এ ধরনের কোনও গবেষণা বাংলাদেশে হয়নি। বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে চলমান ‘গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ’ প্রকল্পের পরিচালক প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, তিনি এই তথ্য দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমি দু’দফায় মুনতাসির মামুনের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, এ ধরনের কোনও গবেষণার তথ্য নেই। আর বাংলাদেশে যাঁরা শহিদ হয়েছেন, তাঁদেরকে আমরা ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে রাখি। এখানে সব ধর্মের মানুষই জীবন দিয়েছেন।
মো. রবিউল ইসলাম
ঢাকা, বাংলাদেশ
মুখোশ
মোহিত রায়ের নিবন্ধে অতি সত্য কথা তুলে ধরা হয়েছে। কলকাতায় বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ হয় রং দেখে। এখানে বিবেক গৌণ। তাই ঘরের পাশে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিপীড়ন ও দেশত্যাগের শিকার হলেও কলকাতার রাজপথে মিছিল হয় না। অথচ, ভিয়েতনাম, লেবাননে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে কলকাতার রাস্তা অচল হয়। এই প্রতিবাদীরা বুদ্ধিজীবী মুখোশের আড়ালে কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন।
২০০৭ সালে মুসলিম মৌলবাদীদের কাছে মাথা নত করে তসলিমাকে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করেছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। অথচ তারাই বাক্স্বাধীনতা নিয়ে কত কান্নাকাটি করে। সেই সময়ে কলকাতার কোনও কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীকে তসলিমার পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। বছর কয়েক আগে বইমেলায় আমন্ত্রিত তসলিমাকে বিমানবন্দর থেকে বিদায় নিতে হয়।
অতীশচন্দ্র ভাওয়াল
কোন্নগর, হুগলি
ব্যক্তিগত বিষয়
মোহিত রায়ের নিবন্ধ প্রসঙ্গে বলতে চাই, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্তিম যাত্রা এক স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রকাশ, যেখানে মনের টানে শামিল হয়েছিলেন দল-মত-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবাই। এটাকে অন্য কোনও মিছিল বা সমাবেশের সঙ্গে তুলনা করা নিরর্থক। এটা করতে গিয়ে তসলিমার বক্তব্য ও মূল বিষয়টাই বিচ্যুত হয়েছে। হ্যাঁ, এ ধরনের সমাবেশে ভিড় সব ক্ষেত্রে সমান হয় না। অভিনয়, সাহিত্য ও মেধার জগতে স্বচ্ছন্দে, স্বগরিমায় বিচরণকারী সৌমিত্রবাবুর যে জনপ্রিয়তা ছিল, সেটা অনেক ব্যক্তিত্বের পক্ষেই ঈর্ষণীয়।
তসলিমা স্পষ্ট জানিয়েছেন, কলকাতা থেকে তাঁকে এক বস্ত্রে বিতাড়নের ক্ষমতা কারও ছিল না। বামফ্রন্ট সরকারের পদক্ষেপ ছিল সংখ্যালঘু ভোটের স্বার্থে। তৃণমূল সরকারও সেই পথের অনুসারী। তসলিমাকে নিয়ে আজ যে দক্ষিণপন্থী শক্তি সরব, তারাও যে তাঁর নাম ব্যবহার করছে সংখ্যাগুরু ভোটবাক্সের দিকে তাকিয়ে, সেটাও তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন। কারণ, তারাও তসলিমার মতো স্বাধীনচেতা, অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বকে ঘৃণা করে।
আশিস সেনগুপ্ত
কলকাতা-৭৩
তসলিমার জন্য
মোহিত রায়ের নিবন্ধে এমন কিছু তথ্য উল্লিখিত হয়েছে, , যার প্রতিবাদ না করাটা অপরাধ হবে। এই দুই পত্রলেখক তসলিমার পরিচিত, যুগ্ম লেখক বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু শুধু নন, তৎকালীন বাম সরকারের দ্বিখণ্ডিত নিষিদ্ধকরণ থেকে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা, আইনজীবী (অধুনা বিচারপতি) শ্রীজয়মাল্য বাগচির ঐতিহাসিক সওয়াল, জয়লাভ, লেখিকার সরকার কর্তৃক বিতাড়নের চূড়ান্ত লজ্জাজনক ফ্যাসিস্ট কাজ ও তার প্রতিবাদে শামিল ছিলেন। তাঁকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনার জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল, তাতে আরও অনেক বন্ধুর সঙ্গে আমরাও ছিলাম। বইমেলায় মিছিল করে প্রতিবাদ করার কারণে আমরা হামলার মুখোমুখি হই। হুমকিও শুনতে হয়েছিল। সেই সময়ে আমাদের সভা, মিছিল বা দাবির সমর্থনে মহাশ্বেতা দেবী, অম্লান দত্ত, শিবনারায়ণ রায়, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, কৌশিক সেন, পল্লব কীর্তনীয়া, বিভাস চক্রবর্তী, শুভাপ্রসন্ন প্রমুখ সুনাগরিক পাশে ছিলেন। তসলিমার উপন্যাস অবলম্বনে দুঃসহবাস সিরিয়াল সম্প্রচার বন্ধ করার জন্য মৌলবাদীরা টিভি চ্যানেলে হামলা করেছিল। তার ফলে বন্ধ হয়ে গেল সিরিয়াল। তার প্রতিবাদে প্রেস ক্লাবে সভা করা হয়েছিল, যাকে সমর্থন করে শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী বিবৃতি পাঠিয়েছিলেন, এবং প্রতিবাদপত্রে সই করেছিলেন।
টিভি চ্যানেলের মালিকের সঙ্গে আমরা কথা বলেছিলাম। তাঁরা সিরিয়াল সম্প্রচারে রাজি হননি। রামের প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে তুলনাটাও যথার্থ নয়। বাংলাদেশে যে দিন তসলিমা পূর্ণ নাগরিকের সম্মান ও সমমর্যাদা নিয়ে, পূর্ণ বাক্স্বাধীনতা নিয়ে ফিরতে পারবেন, সেই দিন স্বদেশে তাঁর প্রকৃত প্রত্যাবর্তন হবে।
সুজাত ভদ্র, কলকাতা-১০
শর্মিষ্ঠা বাগ, কলকাতা-২
শাহবাগের পাশে
মোহিত রায় ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছেন, “সম্ভবত হিন্দু গণহত্যা বলেই এই গণহত্যা ও তার বিচার নিয়ে মিছিলের পশ্চিমবঙ্গ আশ্চর্য রকম নিস্পৃহ।” তথ্যটি ভুল। কলকাতা জানে শাহবাগের হাজারও মুক্তিকামী মানুষের আবেগ ও আপসহীন সাহসকে আগলে রাখার ইতিহাস। প্রেসিডেন্সি এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী ছাত্র-যুবরা গান গেয়ে সংহতি জানায়। কলেজপাড়ায় দেখা যায়, ‘শাহবাগ দীর্ঘজীবী হোক,’ ‘পাশে আছি শাহবাগ’-এর মতো পোস্টার।
অ্যাকাডেমির সামনে থেকে শত শত নাগরিকের মিছিল বার হয়। লোকশিল্পী শুভেন্দু মাইতি দেশাত্মবোধক গান সহযোগে মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন। ছিলেন নাট্যকার চন্দন সেন, বাদশা মৈত্র। বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনের সমর্থনে ‘শাহবাগের পাশে কলকাতা’ নামে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজন করেন। কফি হাউসে শাহবাগ আন্দোলনের চিত্র প্রদর্শনী হয়, থাকেন কবি শঙ্খ ঘোষ। চলে ২৬ মার্চ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। কবীর সুমন গান বাঁধেন ‘তিন মিনিটের জন্য শাহবাগ হল দেশ’।।
শাশ্বত ঘোষ
লিলুয়া, হাওড়া