প্রতিবাদে শামিল জুনিয়র ডাক্তাররা।
কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার অধিকার সকলেরই। যা আজ পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় লুপ্ত। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী হওয়ার দৌলতে খুব কাছ থেকে দেখি ডাক্তারবাবুদের পরিশ্রম। ইন্টার্ন দাদা-দিদিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিরলস ডিউটি করে ক্লান্ত, কিন্তু মুখের হাসিটি অম্লান।
তবু যখন ধেয়ে আসে এ রকম ন্যক্কারজনক আক্রমণ, একটি সরকারি হাসপাতালের প্রাঙ্গণে এক বিশাল দল মেরে খুলি ফাটিয়ে দেয় এক কর্তব্যরত জুনিয়র ডাক্তারের, তখন আশঙ্কা হয়, এই পরিস্থিতিতে, এই নিত্যদিনের ভীতি নিয়ে কাজ করা কি সত্যি সম্ভব?
আঘাতটা আরও লাগে যখন দেখি খবরের কাগজ বা টিিভ চ্যানেলে ওই বিশ্রী ভাবে আহত মানুষটাকে নিয়ে ন্যূনতম কথা খরচ হয়, কিন্তু ১২ ঘণ্টার জন্য আউটডোর বন্ধ রেখে ডাক্তাররা যে কত বড় পাপ করেছেন, সেটা প্রমাণ করে একগুচ্ছ একপেশে খবর প্রকাশিত হয়।
কত দিন ক্লাস করতে করতে শুনেছি বাইরে চলছে গন্ডগোল। সে খবর যায় না কারও কাছে।
তিস্তা সান্যাল
কলকাতা-৭৫
বাহবা সংস্কৃতি
চিকিৎসার জন্য আমি ভেলোর, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। সেখানেও দেখেছি উপচে পড়া ভিড়, কিন্তু রোগীরা সুশৃঙ্খল, হাসপাতাল চত্বরে পুলিশ নেই, এমনকি হাসপাতালের সিকিয়োরিটি গার্ডদের হাতে সামান্য লাঠি পর্যন্ত নেই। রোগীরা ডাক্তারদের সম্মান করেন, ডাক্তারবাবুরাও সকলকে শান্তিতে এবং ঠান্ডা মাথায় মনের মতো করে যথেষ্ট ভাল চিকিৎসা পরিষেবা দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের বাংলার সংস্কৃতি— ডাক্তারদের এখানে বহু বছর ধরে নানা অছিলায় পেটানো হয় এবং যারা পেটায় তারা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় আজ পর্যন্ত সম্ভবত শাস্তি হয়নি, হলেও সংবাদে অন্তত তা প্রকাশ হয়নি। আজকাল এই রাজ্যের বহু মেধাবী ছাত্র আর ডাক্তারি পড়তে চান না, হয় অন্য স্ট্রিম বেছে নেন, বা অন্য রাজ্যে ডাক্তারি পড়তে যান।
কিছু দিন আগে ‘বিমারু প্রদেশ’ উত্তরপ্রদেশে অক্সিজেনের অভাবে অনেক শিশু মারা গিয়েছিল। অনেক হল্লা হয়েছিল, কিন্তু সেখানকার লোকেরা ডাক্তার পেটানোর কথা ভাবতেও পারেননি। আমরা আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করি, অথচ এখানেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে মৃত্যুর মিছিল হয়, রাজনৈতিক হানাহানি নিত্যসঙ্গী, ডাক্তার পেটানো জলভাত।
হরলাল চক্রবর্তী
কলকাতা-৪
আন্দোলনের মুখ
চিকিৎসক নিগ্রহের বিরুদ্ধে ডাক্তারদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এত সফল ও স্বতঃস্ফূর্ত অরাজনৈতিক আন্দোলন এ রাজ্যে হয়নি। অবধারিত প্রশ্ন, এর পর কী? আন্দোলন কোন পথে চলবে? আন্দোলনকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে হলে যোগ্য নেতৃত্ব চাই। সে রকম কোনও মুখ কিন্তু চোখে পড়ছে না। রাজনীতি না করা, ক্ষমতার রাজনীতি বৃত্তের বাইরে থাকা এক দল ডাক্তারকে দায়িত্ব নিতে হবে।
আর একটা কথা ভাবারও দরকার আছে, রোগী দেখা বন্ধ করা একটা আবেগের বশে নেওয়া সাময়িক সিদ্ধান্ত। এটা দীর্ঘ কাল চলতে পারে না। রোগী না দেখলে আমাদেরও (আমিও ডাক্তার) ক্ষতি। আমরা অন্য কাজ জানি না। তা ছাড়াও আমাদের শিক্ষা, আদর্শ, নীতি, চেতনা দীর্ঘ দিন ধরে এ কাজটা আমাদের করতে দেবে না। আর জনগণ? এ আন্দোলন তাদের উপর কী প্রভাব ফেলবে?
আমাদের সবচেয়ে কাছের যারা, তারাও কিন্তু বিপক্ষে চলে যাবে। এখনও যে তারা সর্বতো ভাবে আমাদেরই পক্ষে, সে দাবি করাও অবশ্য ঠিক নয়। দীর্ঘ দিন ধরে রোগী বয়কট চললে যে কোনও মৃত্যুর জন্যই ডাক্তারকে দায়ী করা হবে, সংবাদমাধ্যম রং চড়িয়ে খবর পরিবেশন করবে, ডাক্তাররা ভিলেন হয়ে যাবেন। গণরোষ বাড়বে, কোথাও সহানুভূতি পাওয়া যাবে না।
অনেক সাধারণ মানুষও আমাদের সমর্থন করেছেন, এটা খুব বড় ব্যাপার। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে কোনও আন্দোলনই সফল হতে পারে না। এটা তো ঠিকই, দেশের শতকরা নব্বই ভাগ লোক ডাক্তারদের গায়ে হাত দেওয়ার কথা, নিগ্রহ করার কথা ভাবেন না। তবে এ রকম ঘটনায় কেউ প্রতিবাদও করেন না। এটা আমাদের বৈশিষ্ট্য, কোনও ঝামেলায় না জড়ানো। তাই পাশের বাড়ির মেয়েকে পাড়ার ছেলেরা টিটকিরি দিলে, আমরা প্রতিবাদ না করে, নিজের মেয়েকে বাড়ি থেকে বেরোতে দিই না। ডাক্তার পেটালে হয়তো একই মানসিকতায়, উপস্থিত অন্য রোগীরাও প্রতিবাদ করেন না। তবু এই নিরীহ, নিস্পৃহ, মেরুদণ্ডহীন সব মানুষকে নিয়েই আন্দোলন করতে হবে। তাঁরাই বৃহত্তর সমাজ এবং আমাদের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে তাঁদের অধিষ্ঠান।
পার্থপ্রতিম পাল
হাওড়া
দু’টি দিক
জুনিয়র ডাক্তারদের এ হেন দুর্ভোগের মধ্যে মাঝেমধ্যেই পড়তে হয়। একেবারে নিম্নবিত্ত না হলে সাধারণত কেউ সরকারি হাসপাতালে আত্মজনকে ভর্তি করাতে চান না। এই সব তথাকথিত পিছড়ে বর্গের মানুষের কাছে শিক্ষা বা সামাজিক বোধের দায় আমরাই পৌঁছে দিতে চাই না। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁরা আশা করেন, মৃতসঞ্জীবনীর দ্বারা আরোগ্যলাভ করবেন। নতুবা এক বৃদ্ধের মৃত্যুতে এমন উন্মাদ প্রতিক্রিয়া হয় না। আর এই সময় মৃতের পরিজনদের সঙ্গে যোগ দেয় কিছু অসামাজিক মানুষ, মস্তান, গুন্ডা।
আবার, এই জুনিয়র ডাক্তাররা দু’এক জন আহত হলেই, হলই বা গুরুতর, সমস্ত সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার স্পর্ধা রাখেন, এও অবিশ্বাস্য। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পঙ্গু করে এঁরা কী চাইছেন? গরিব রোগীরা মারা যান বা বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে সর্বস্ব হারান?
স্বপ্না দেব
কলকাতা-৫৫
ভোগান্তি
জুনিয়র ডাক্তাররা কাজ বন্ধ করে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে লাটে তুলে ক্ষমতা প্রদর্শন করলেন। সারা রাজ্যে কত শত সহস্র মানুষের ভোগান্তি হল বা কত জন মৃত্যুমুখে পতিত হলেন, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করলেন না। রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মঘট বা বন্ধ ডাকলেও বিশেষ কিছু পরিষেবা তার বাইরে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম চিকিৎসা পরিষেবা। যদি কোনও দিন পুলিশ ও সেনাবাহিনী সপ্তাহখানেকের জন্য কর্মবিরতি পালন করতে উদ্যত হয়, কী অবস্থা দাঁড়াবে?
সেন্টু দত্ত
রাইপুর
হুঁশিয়ারি!
এই জটিল এবং সংবেদনশীল সমস্যাটির সমাধানে রাজ্য সরকারের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দরকার ছিল। তা তিনি করেননি। অচলাবস্থা দূর করতে, পরে ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু এনআরএসের পরিবর্তে, তিনি এলেন পিজি-তে। এসে কী করলেন? সমস্যা সমাধানে যেখানে দরকার ছিল বিচক্ষণতা, সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, সেখানে মুখ্যমন্ত্রী কথা বললেন হুমকির সুরে! সেখানে নেই সহমর্মিতার বিন্দুমাত্র প্রকাশ। হঠাৎ এর মধ্যে তিনি সিপিএম-বিজেপির উপস্থিতি টের পেলেন। বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন মস্তিষ্কপ্রসূত আরও বহু কথা হাওয়ায় ভাসিয়ে, পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুললেন। চার ঘণ্টার মধ্যে কাজে যোগ না দিলে কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিলেন। এর ফলে অবস্থা কি স্বাভাবিক হতে পারে? এর ফলে তো এই সমস্যার সমাধান আরও বিলম্বিত হবে, ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কের আরও অবনমন ঘটবে!
গৌরীশঙ্কর দাস
সাঁজোয়াল, খড়্গপুর
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।