তূর্য বাইন-এর ‘বুড়ো আঙুল দেখিয়েই ভেজাল’ (১৮-৭) শীর্ষক প্রবন্ধে মাছ-সহ অন্যান্য খাদ্যবস্তুতে ‘কৃত্রিম রঞ্জক এবং নিষিদ্ধ রাসায়নিক’ ব্যবহার প্রসঙ্গের মধ্যে মাছ নিয়ে কয়েকটি কথা। নদী-নালা-খাল-বিল পূর্ণ বাংলায় প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালি মাছ খেত বলে অনুমান। আর সে কারণে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ শব্দবন্ধ বহুশ্রুত। আমাদের রাজ্যের চন্দ্রকেতুগড়ে পোড়ামাটির ফলকে মাছের চিত্র পাওয়া যায়। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে চিংড়ি, কচ্ছপের ডিম, ভেটকি-সহ একাধিক মাছের কথা উল্লেখ আছে। আর ষোড়শ শতকে, বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যে আছে সর্ষের তেলে মাছ রান্নার বিভিন্ন বিবরণ।
মাছের প্রসঙ্গ এসেছে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ মুজতবা আলি প্রমুখের লেখায়। আর স্বামী বিবেকানন্দের ইলিশ-প্রীতি তো বিশ্ববিখ্যাত। বাঙালির অতিরিক্ত মৎস্যপ্রীতির সুযোগ নিয়ে মাছের কারবারিরা শুরু করেন রাসায়নিক ব্যবহার। এমনিতেই জলাশয় বা সমুদ্র থেকে মাছে পারদ, সিসা, ক্রোমিয়াম, মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রভৃতি বিষ ঢোকে। এর পর সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত ফর্মালিন-এর পাশাপাশি অন্যান্য ব্যবহৃত রাসায়নিকও প্রভাব ফেলছে মানুষের শরীরে। বাঙালি মৎস্যরসিক বলে কি বিষ খেতে থাকবে? ব্যবসায়ীদের অসাধু কারবার আইন করে বন্ধ হওয়া দরকার।
নন্দগোপাল পাত্র, সটিলাপুর, পূর্ব মেদিনীপুর
দিশি টোটকা
তূর্য বাইনের লেখা প্রবন্ধটি নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী রচনা। খাবারে মেশানো কৃত্রিম রং শুধু নয়, রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকও সমান ভাবে স্বাস্থ্য ও প্রকৃতি-পরিবেশের পক্ষে বিপজ্জনক। কয়েক বছর আগে, তারকেশ্বরের দিকের একটা গ্রামে গিয়েছিলাম এক আত্মীয়ের বাড়ি। নানান কথায় জানতে পারি, গ্রামের পুকুরে আর গেঁড়িগুগলি হয় না। সৌজন্যে, ধান চাষে ব্যবহৃত কীটনাশক। বৃষ্টির জলে সে সব ধুয়ে পুকুরে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুকুরের বাস্তুতন্ত্র। অথচ, গ্রামের আদিবাসী ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের কাছে এইগুলোই ছিল গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির উৎস।
এ দিকে সার দিতে দিতে জমির স্বাভাবিক উর্বরতা এমন তলানিতে এসে ঠেকেছে যে, সার না দিলে চাষই হয় না। তার জন্য বেড়েছে চাষের খরচ আর কমেছে পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যের জোগান। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন মজুতদারকে খাবারে রং মেশাতে হচ্ছে? কৃষককে কেন এমন সারের ব্যবহার করতে হচ্ছে, যাতে আনাজপাতি এমন দানবীয় রূপ লাভ করে? এখানে ‘ক্রেতার পছন্দ’ বড় ভূমিকা পালন করে। বেলা বারোটায় বাজার গিয়েও আমরা ‘ফার্ম ফ্রেশ’ খুঁজি। সেখানে পছন্দ না হলে শপিং মল, আর তা-ও না হলে অনলাইন। কে চায় ক্রেতাকে হাতছাড়া করতে? অতএব রংই ভরসা।
এখন বিষয় হচ্ছে এই ‘ফার্ম ফ্রেশ’ ব্যাপারটি কিন্তু আমরা নিজেরাই গড়ে তুলতে পারি। ভারতের নানান জায়গায়, বিশেষত দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে আবাসনের ছাদে করা হচ্ছে অরগ্যানিক ফার্মিং। সকল আবাসনবাসীর কাছ থেকে আনাজের খোসা সংগ্রহ করে সার বানিয়ে গোটা আবাসনের খাদ্যের জোগান হয়ে যাচ্ছে। সফল অরগ্যানিক ফার্মিং-এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সিকিম এবং কিউবা হলেও, তাদের কথা ভুলেও কোনও গণমাধ্যমে দেখি না। আর আমাদের রাজ্যে এ বিষয়ে উন্নয়ন বড়ই বেদনাদায়ক।
আশার কথা এটাই যে, এখানেও বহু ছোট ছোট সচেতন নাগরিক উদ্যোগ তৈরি হচ্ছে, যাঁরা সরাসরি উৎপাদকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মাঠে নেমে কাজ করছেন। সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন উপভোক্তাদের সঙ্গে। উপকৃত হচ্ছেন দুই তরফের মানুষই। দেশের নানা প্রান্তে এখনও অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী আছেন, যাঁরা দানবীয় সবুজ বিপ্লবকে এড়িয়ে নিজেদের প্রথাগত চাষাবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে যদি উপভোক্তারা যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন, তবে লাভ দু’তরফেই।
তার সঙ্গে সচেতন হতে হবে আমাদেরও। দাগ-পোকাবিহীন ধবধবে পরিষ্কার খাবারের বদলে বেছে নেওয়া উচিত স্বাভাবিক দেখতে খাবার। চালে, ডালে একটু-আধটু পোকা থাকবে, এ তো স্বাভাবিক। ধুলেই তা চলে যায়। কোনও বড় কোম্পানির ব্র্যান্ডেড মশলার থেকে ভরসা থাকুক পাড়ায় কুটির শিল্পগুলির উপর, গমভাঙানো কলের উপর। শুধুমাত্র খাবারের ব্যাপারেই নয়, চেষ্টা থাকা উচিত জীবনের অন্যান্য জায়গাতেও যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক জিনিস ফিরিয়ে আনা। নাইলন জালির বদলে বাসন পরিষ্কারের ক্ষেত্রে ফিরে আসুক ধুঁধুল, নারকেলের ছোবড়া। আমাদের ক্রান্তীয় গ্রীষ্মপ্রধান দেশে সুতির পোশাক ব্যবহারই উপযুক্ত। কৃত্রিম ফেব্রিক যেমন ত্বকের ক্ষতি করে, তেমনই এর রোঁয়া বাথরুমের পাইপ বেয়ে নদী-নালা দিয়ে পড়ে সমুদ্রে। যে হেতু এগুলো কোনও ভাবেই প্রকৃতিতে মিশে যায় না, তাই শেষ পর্যন্ত ঠাঁই হয় মাছের পেটে আর ঘুরেফিরে জায়গা করে নেয় আমাদের পাতে। নামীদামি বিদেশি ফলে নানা রকম প্রিজ়ারভেটিভ ব্যবহারের কারণে তাতে পুষ্টিগুণ কিছু অবশিষ্ট থাকে না। কেনা উচিত দিশি ফল। এতে স্বাস্থ্য, পরিবেশের পাশাপাশি লাভ হবে অর্থনীতিরও।
গীতশ্রী কোলে, কলকাতা-৬০
সচেতনতা চাই
এক রবিবাসরীয় মাছের বাজারে মাছ বিক্রেতার সঙ্গে এক ক্রেতার তুমুল কথা কাটাকাটি চলছিল। কৌতূহলবশত সামনে গিয়ে দেখি বিক্রেতা বার বার ক্রেতা ভদ্রলোককে বোঝাচ্ছিলেন, “আমি যে পাবদা মাছ বিক্রি করছি, এতে কোনও রং মেশানো নেই, তাই মাছটা একটু ফ্যাকাশে লাগছে।” এর উত্তরে শুনলাম, “তোমাকে কি কেউ বলেছে এই ভাবে মাটির রঙের মতো পাবদা মাছ বিক্রি করতে? এতে বুঝব কী করে মাছটা ভাল না খারাপ? আজ তোমার কাছ থেকে মাছ কিনতে পারব না।” শুনে বিক্রেতা স্বগতোক্তি করলেন, “ঠিক আছে, এর পর থেকে রং-মাখানো মাছই আনব।”
এই ঘটনা মনে করে তূর্য বাইনের প্রবন্ধের সঙ্গে সামান্য হলেও ভিন্নমত প্রকাশে বাধ্য হলাম। আমরা বাজারে গিয়ে কখনওই ভাবি না যে, গ্রীষ্মকালে এত নধর বেগুন প্রাকৃতিক নিয়মে কী ভাবে ফলতে পারে। কিসের প্রভাবেই বা বিভিন্ন ডেয়ারির দুধ মোড়কবন্দি অবস্থায় সকাল থেকে অনেক বেলা অবধি সূর্যালোকে পড়ে থাকলেও কেটে যায় না। আবার ফর্মালিন মেশানো আছে জানা সত্ত্বেও বাজার থেকে আমরা কিনে আনি খোলা পনির। নামী কোম্পানির মশলায় হাত রাঙিয়ে গেলেও কখনওই মনে প্রশ্ন আসে না, কেন এটা হচ্ছে।
তবে খোলা বাজারে কোন পণ্য ভেজাল, কোনটা নকল বা কোনটাতে কীটনাশক মেশানো আছে, এই সকল বিধিভঙ্গের ব্যাপারে ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অব ইন্ডিয়া কোনও ভাবেই দায়বদ্ধ নয়। শুধুমাত্র মোড়কবন্দি পণ্য ফুড সেফটির নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি মেনে উৎপাদন করলে তবেই অনুমোদন পেয়ে থাকে, যা দেখে ক্রেতারা সেই পণ্যের গুণগত মান সম্বন্ধে নিশ্চিত হন। যদিও এর মধ্যেও অনেকে বিধিভঙ্গ করে থাকেন, সেই অভিযোগও ওঠে। ‘সেন্ট্রাল কনজ়িউমার প্রোটেকশন অথরিটি’ কর্তৃক স্থানীয় স্তরে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধের বিরুদ্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক শ্রেণির আধিকারিকদের দীর্ঘ শীতঘুমের জন্যেই আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে সময়মতো ব্যবস্থা করা নিয়ে লেখক উপভোক্তাদের তরফে সঠিক প্রশ্নই তুলেছেন। এটাও আবার অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শিক্ষিত ও আর্থিক ভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরা বহুলাংশেই শুধুমাত্র দাম ও চাকচিক্য দেখে পণ্যের গুণগত মান যাচাই করতে গিয়ে এই অনৈতিকতার কবলে তুলনামূলক ভাবে বেশি পড়েন। সুতরাং, এই সমস্ত বিধিভঙ্গের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সময়মতো আইনি পদক্ষেপ করার সঙ্গে সাধারণ মানুষেরও সর্বাগ্রে সচেতন হওয়া উচিত বলেই মনে হয়।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি