ক্ষুধার সূচকে পৃথিবীর ১১৬টা দেশের মধ্যে আমরা রয়েছি ১০১-এ।
‘অসাম্য’ (৫-৯) সম্পাদকীয়তে যথার্থ উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০১৪ সালের পর থেকেই দেশের আর্থিক বৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে। যার ফলে গত আট বছরে আর্থিক অসাম্য দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে।
আর্থিক অসাম্য দুনিয়া জুড়ে আগেও ছিল, আগামী দিনেও থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশে এর চেহারাটা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, ২০২২-এর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত আমাদের আর্থিক বৃদ্ধির হার ১৩.৫ শতাংশ, যা কিনা ব্রিটেনের থেকেও বেশি। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ এখন আমরা। ভারতের আগে আছে আমেরিকা, চিন, জাপান ও জার্মানি। কিছু দিনের মধ্যেই পৃথিবীর সবচেয়ে অর্থবানদের তালিকায় একেবারে প্রথমের দিকে থাকতে চলেছে এক ভারতীয়ও। অথচ, গত অগস্ট মাসে গোটা দেশের বেকারত্বের হার ছিল ৮.৩ শতাংশ (শহরে ৯ শতাংশ ও গ্রামে ৭.৭ শতাংশ)। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সূচক গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। ক্ষুধার সূচকে পৃথিবীর ১১৬টা দেশের মধ্যে আমরা রয়েছি ১০১-এ। এর থেকেই পরিষ্কার যে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ‘ট্রিকল ডাউন’ পন্থা, অর্থাৎ উন্নয়নের ফল চুইয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবে— এই পদ্ধতিতে চলছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সে দেশের নিম্নবিত্ত মানুষদের যে রকম আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে থাকে, তার ছিটেফোঁটাও আমাদের দেশের প্রান্তিক মানুষরা পান না। প্রতি বছর বাজেটে ১০০ দিনের কাজের ব্যয়বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। দিনমজুররা ন্যূনতম মজুরিও পান না। গালভরা সামাজিক প্রকল্প থাকলেও তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয় না। যার ফলে, দেশের বেশির ভাগ মানুষই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং হতাশার শিকার।
অথচ, এই মানুষের ভোটেই পর পর দু’বার নরেন্দ্র মোদী সরকার গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাস বলছে, এ ভাবে চলতে থাকলে দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়, যা কিনা বিদেশি বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়। এখন দেখার, স্বাধীনতার শতবর্ষকে সামনে রেখে ‘সকলের জন্য কাজ ও আর্থিক অসাম্য দূর করার’ প্রধানমন্ত্রীর এই সঙ্কল্প পূরণে সরকার কী কী পদক্ষেপ করে।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
কাজের সুরক্ষা
দিনমজুরদের আত্মহত্যা নিয়ে ‘অসাম্য’ সম্পাদকীয় সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। দেশের স্বাধীনতা ৭৫ বছর পার হল। আজও কাজ না পেয়ে বা কাজ হারিয়ে মানুষ আত্মহত্যা করছেন, এটা দেশের পক্ষে লজ্জার। মানুষ শিক্ষিত হন, সংসারের স্বপ্ন দেখেন। খাবার, পোশাক, বিদ্যুৎ, মোবাইল চার্জ, ডাক্তারের খরচ— সংসারে হরেক দায়িত্ব। এ ছাড়া সন্তানের শিক্ষার খরচ লাগেই। এগুলো না হলে মানুষ দুশ্চিন্তায় দিনযাপন করেন। সংসারের অশান্তিতে জেরবার মানুষ আত্মহত্যা করেন, তিনি শিক্ষিত হন, বা স্বল্পশিক্ষিত দিনমজুর। সংসার প্রতিপালনের জন্য সকলে এমন কাজ খোঁজেন, যে কাজে অর্থের নিরাপত্তা থাকবে, অনিশ্চয়তা থাকবে না, মালিক বা সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কাজ হারাতে হবে না। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও তেমন কাজ পাচ্ছেন না বেশির ভাগ মানুষ।
বিত্তবান ঘরের সন্তানরা বড় স্কুলে শিক্ষালাভ করেও পিছনের দরজা দিয়ে চাকরিতে ঢুকছেন। ক্ষমতাবান আত্মীয় বা ‘আপন’ লোক থাকলে অযোগ্যরাও চাকরির সুযোগ পাচ্ছে। এমন ‘অসাম্য’ দেশের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে বইছে। দেশের নেতারা বলছেন, কাজের পিছনে না ঘুরে ব্যবসা করতে। ব্যবসা করতে গেলেও টাকার প্রয়োজন হয়। যাঁদের অর্থ নেই, ব্যাঙ্ক তাঁদের ঋণ দিতে চায় না। তা ছাড়া ব্যবসায়ী বা শিল্পোদ্যোগী হওয়া কি মুখের কথা?
দিনমজুররা দশটা-পাঁচটার চাকরি চাইছেন না। কাজ করে বেতন চাইছেন, যা নিয়ে দোকান থেকে চাল-আনাজ কিনে ঘরে ফিরতে পারবেন। তেমন কাজেরও সুরক্ষা নেই, নমনীয়তা নেই। নীতি আয়োগের ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য কী করছে? এক-একটি সরকার আসছে আর নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের। সত্যিই বাজারে এখন ‘সাঙাততন্ত্র’ বিদ্যমান। যদি দেশের শ্রমজীবীদের পেটে ভাত জোগানোর মতো কাজ না জোটে, তা হলে বড় বড় সংস্কার করে কী হবে? দেশের ভবিষ্যৎ আরও সঙ্গিন হবে কেবল।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এক্তেশ্বর, বাঁকুড়া
বিশ্বজয়ের স্বপ্ন
শিক্ষক দিবসে মুখ্যমন্ত্রী আশা প্রকাশ করলেন, যে ভাবে বাংলার ছেলেমেয়েরা তৈরি হচ্ছে, তাতে সারা বিশ্ব তারা মেধা দিয়ে দখল করে নেবে (‘ভুল মেনেই ৮৯ হাজার চাকরির কথা’, ৬-৯)। মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলার ছাত্রছাত্রীরা কী ভাবে তৈরি হচ্ছে, তা কি তিনি সত্যিই জানেন না? উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ এক জন ছাত্রী যখন ইংরেজি ‘আমব্রেলা’ শব্দটির অশুদ্ধ বানান করে, তখন আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, দোষটা ঠিক ওই ছাত্রীর নয়, বরং বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার। দলীয় রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে রাজ্যের শিক্ষার প্রকৃত অবস্থার খোঁজটুকু রাখার অবকাশও সম্ভবত তাঁর হয় না।
কেন রাজ্য প্রশাসন ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ না ভেবে কথায় কথায় বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করছে? হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী শ্রেণিকক্ষের ন্যূনতম জ্ঞানটুকু অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে। এ দিকে উচ্চ মাধ্যমিকের যে সব অনুত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রী খাতা রিভিউয়ের আবেদন করেছিল, তাদের নম্বর বাড়িয়ে পাশ করিয়ে দিতে কোনও কার্পণ্য করেননি শিক্ষাজগতের কর্তারা। এ ভাবে পাশ করিয়ে দিয়ে, পাশের শতকরা হার বৃদ্ধি দেখিয়ে সরকার আনন্দিত হতে পারে। কিন্তু পাশের শংসাপত্র হাতে থাকলেই কি ছেলেমেয়েরা প্রকৃতই শিক্ষিত হচ্ছে?
সমীর কুমার ঘোষ, কলকাতা-৬৫
নৈরাজ্য
সুকান্ত চৌধুরীর ‘পাশ কাটিয়ে, চেপে গিয়ে’ (৮-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যের বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ এবং তার সম্ভাব্য ফলাফল সুন্দর ভাবে প্রতিভাত হয়েছে। শিক্ষার অগ্রগতিকে আলোকবৃত্তে আনতে গিয়ে বছরের পর বছর মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্ত নম্বর বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কৃতকার্য ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। এই কাজ করতে গিয়ে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে ভিন্ন কোনও পদ্ধতিকে। অনুসরণ করা হয়েছে বিকল্প পথ।
২০১৬ সালের মাধ্যমিক ফল প্রকাশের দিন কয়েক বাদে স্থানীয় এক সেলুনে দেখি অল্পবয়সি একটি ছেলে বেঞ্চে বসে তাল ঠুকে গুনগুন করে গান গাইছে। ছেলেটির চুল কাটার পালা আসতেই, সে সানন্দে আমাকে তার জায়গা ছেড়ে দিল। সে জানাল, তার বাবা মুদি দোকানে কাজ করেন। সামান্য আয়। বাড়িতে আজ পাঁঠার মাংস সহযোগে খাবার আয়োজন, কারণ বংশে সে-ই প্রথম মাধ্যমিক পাশ করেছে। ছেলেটির বক্তব্য, সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, অন্যান্য বিষয়ে উতরে গেলেও ইংরেজিতে পাশ করবে। কারণ, বাক্য গঠন দূরের কথা, ইংরেজি শব্দ সে ঠিকমতো পড়তে পর্যন্ত পারে না। ২০ নম্বরের উত্তর দিয়ে তার প্রাপ্ত নম্বর ৪২। ছেলেটি নিজেও বুঝতে পারছে না, সেটা কী ভাবে সম্ভব হল! এ দিকে সরকারপোষিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই নিজেদের সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে জাহাজডুবি থেকে, বাঁচাবে কে?
অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা