সত্তর দশকের শেষ ও আশির দশকের শুরু তখন। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের যে খেলাই থাক, আমাদের বাড়ির সকলে ঠায় বসে টিভির সামনে। বাবা তো দেখতেনই। তাঁর নাম ছিল ননীগোপাল গোস্বামী, ভাল খেলোয়াড় ছিলেন, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। আমার দাদা দীপক গোস্বামী ওই সময়ে ইস্টবেঙ্গলের এক জন কর্মকর্তা ছিলেন। মা বসে থাকতেন, কখন তাঁর ‘দিপু’কে দূরদর্শনে দেখাবে।
আমাদের এক বোনের বিয়ের দিন ফাইনাল খেলা ছিল। ইস্টবেঙ্গল জিতেছিল। বাড়ির ছেলেরা খেলার মাঠ থেকে ঝোড়ো কাকের চেহারা নিয়ে বরযাত্রী গেল। পাত্রীর বড়ভাইও। এক দিকে গোধূলি লগ্নে মণ্ডপে বিয়ে চলেছে, অন্য দিকে জেতার আনন্দে হইচই।
আমার বড় ছেলে তখন আইআইটি-তে পড়ছে। ইন্টার আইআইটির ফাইনালে ভলিবলের ক্যাপ্টেন। সেই খেলা দেখতে যাই। প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সস্ত্রীক খেলার মাঠে। না, এগিয়ে পরিচয় দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়নি। আফশোস হয়। আমার ছোট ভাইয়েরা সকলেই খেলাধুলোয়, বিশেষত ফুটবলে পারদর্শী। ছোট সন্দীপ ইউনিভার্সিটি টিমে খেলেছে। বাবাকে প্রাইজ় শিল্ড এনে বলেছিল, ‘‘এই যে, তোমার চুইন্যা শুধু পারে না। আমিও পেরেছি।’’ ‘চুইন্যা’ মানে বাবার আত্মীয় চুনী গোস্বামী! বাবা খুব গর্বিত ছিলেন তাঁকে নিয়ে।
দশ বছর হল, দীপক গোস্বামী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চলে গিয়েছেন। মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে এক কলম প্রশংসাবাক্য তো দূরে থাক, ক্লাবের কেউ তাঁর নামটুকু উল্লেখ পর্যন্ত করেননি।
তবু বিনম্র অভিনন্দন জানাই লাল-হলুদ জার্সিকে।
বন্দনা ভট্টাচার্য
কলকাতা-১৩৬
রামরাম নিয়ে
‘রামরাম বসু’ (১৭-৮) শীর্ষক চিঠিতে সুরঞ্জন মিদ্দে যা বলতে চেয়েছেন, তাঁর সঙ্গে অনেকটাই সহমত। তবে দু’একটা প্রশ্ন। উনি লিখেছেন, “কেরী সাহেবের মুন্সী উপন্যাসে রামরাম বসুর চরিত্রটি খুব প্রশংসনীয় নয়। কিন্তু তিনি কি সত্যিই ও-রকম?” বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ প্রকাশিত ‘সাহিত্য সাধক চরিতমালা’য় (৬) রামরাম বসু সম্বন্ধে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কিন্তু ১৭৯৬ খৃষ্টাব্দে এমন একটি ঘটনা ঘটিল, যাহার ফলে কেরী তাঁহার মুন্সী রামরাম বসুকে ত্যাগ করিতে বাধ্য হইলেন। মহীপালদীঘিতে টমাস এক দিন লোকমুখে জানিতে পারিলেন যে, রামরাম বসু কিছুদিন হইতে একটি তরুণী বিধবার প্রতি আসক্ত এবং এই বিধবার একটি সন্তান হওয়াতে শিশুটিকে গোপনে হত্যা করা হইয়াছে। ব্যাপারটা সত্য কি না, অবিলম্বে তদন্ত করিবার জন্য টমাস কেরীকে লিখিয়া পাঠাইলেন। অনুসন্ধানে সকলই প্রকাশ পাইল এবং সঙ্গে সঙ্গে রামরাম বসুও মদনাবাটি ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন। কেরী ও টমাস উভয়েই রামরাম বসুকে নিষ্কলঙ্ক চরিত্র জ্ঞান করিতেন, তাঁহার এই পদস্খলন মিশনারীদের দারুণ মনঃকষ্টের কারণ হইয়াছিল।”
যদিও রামরাম তখন কেরি সাহেবের মুনশি, কিন্তু কেরির থেকে এই দুঃখ টমাস বেশি পেয়েছিলেন, কারণ টমাসের সঙ্গে রামরামের যোগাযোগ হয়েছিল ১৭৮৭-র মার্চ মাসে, যেখানে কেরির সঙ্গে যোগাযোগ নভেম্বর, ১৭৯৩-এ, অর্থাৎ মাত্র আড়াই-তিন বছরের।
এই একই খবরের কথা উল্লেখ করেছেন ইন্দ্রমিত্র, তাঁর ‘পশ্চাৎপট’ বইয়ে। সেই যে রামরাম বসু পালিয়ে গিয়েছিলেন (অথবা তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল— এ কথা বলেছেন ইন্দ্রমিত্র), তার পরে আবার কেরির সঙ্গে রামরামের যোগাযোগ হল প্রায় পাঁচ বছর পরে। অর্থাৎ ১৮০০ সালের মে মাসে, যখন কেরি শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনে আসেন, তার থেকে চার-পাঁচ মাস আগে। এর পরে অবশ্য রামরাম বসু সম্পর্কে এ রকম কোনও কলঙ্কযুক্ত খবর পাওয়া যায় না।
রামরাম বসুর সাহিত্যকর্ম সম্বন্ধে পত্রলেখক বলেছেন, “তাঁর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত’(১৮০১) বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক ঐতিহাসিক জীবনীসাহিত্য।” এ ব্যাপারে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত’ বইয়ের অংশ উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না।
অসিতকুমার লিখেছেন, ‘‘তাঁহার দুইখানি গ্রন্থ ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ (১৮০১) এবং ‘লিপিমালা’(১৮০২) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য— অবশ্য কোন সাহিত্যগুণের জন্য নহে। ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুদ্রিত গদ্যগ্রন্থ— ইহাই ইহার একমাত্র গৌরব। রামরাম বসু প্রতাপাদিত্যের জ্ঞাতি, তিনি নিজেও প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে অনেক জনশ্রুতির সংবাদ রাখিতেন। সুতরাং জাতীয় বীরের চরিত্ররচনায় তিনি যোগ্যতম ব্যক্তি বলিয়া কেরী তাঁহাকে এই ভার দিয়াছিলেন। রামরাম অযথা অজস্র ফারসী শব্দ প্রয়োগ করিয়া পুস্তিকাখানিকে অপাঠ্য করিয়া ফেলিয়াছেন; উপরন্তু পদান্বয় ও পদন্যাস সম্বন্ধে তাঁহার বিশেষ কোন ধারণাই ছিল না। ফলে, ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্রে’র ভাষা সে-যুগের পাঠকের কাছে কিরূপ লাগিত জানি না, কিন্তু এ যুগের পাঠকের কাছে মনে হইবে, “মটর-কড়াই মিশায়ে কাঁকরে চিবাইল যেন দাঁতে”। তবে ভাষার উজান ঠেলিয়া অগ্রসর হইতে পারিলে দেখা যাইবে যে, তিনি বাংলা ভাষা গঠনে কিছু কৃতিত্ব দেখাইয়াছেন। অবশ্য উৎকট বাগ্ভঙ্গিমার অনভ্যস্ত পদচারণায় তাঁহার সামান্য কৃতিত্বটুকুও উবিয়া গিয়াছে।”
স্বপন কুমার ব্রহ্ম
কলকাতা-৭৫
শোক, দেখনদারি
‘বাবার বাৎসরিকের দিন মৃত্যু ছেলের’ (২০-৮) শীর্ষক মর্মান্তিক প্রতিবেদন পড়লাম। বাৎসরিক এক ধরনের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। সেই দিন মৃত ব্যক্তির প্রতি শোক ও শ্রদ্ধা নিবেদনই প্রথম ও শেষ কথা। সেটুকু করলেই হয়। পবিত্র হওয়ার জন্য ঝুঁকি নিয়ে গঙ্গায় স্নান করতে বা তর্পণ করতে গিয়ে গঙ্গায় তলিয়ে যাওয়া নতুন ঘটনা নয়। এ ধরনের আচার অনুষ্ঠান ছাড়া কি বিদেহী আত্মার প্রতি শোক শ্রদ্ধা পালন করা যায় না? নীরবে নিভৃতে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলেও আত্মার শান্তি কামনা করা যায়।
সাধারণত শ্রাদ্ধেও যে আচার অনুষ্ঠান পালন হয়, তাতে সামাজিক দেখনদারিই বেশি থাকে। কোথাও কোথাও তো প্রায় বিয়েবাড়ির মতো আয়োজন করা হয়। হইহই, চেঁচামেচি, ‘‘আরও দুটো মাছ এ দিকে’’, ‘‘চিংড়িটা রিপিট করুন’’। কিলো কিলো চাল, সব্জি, ফলমূল, মিষ্টি, থালা বাসন বিছানা বিদেহী আত্মার প্রতি নিবেদন করা হয়। নগদ টাকা তো আছেই। বৃদ্ধ বাবা-মা’কে বৃদ্ধাশ্রম বা বনবাসে পাঠালেও, ঠিকমতো খোঁজখবর না রাখলেও, তাঁদের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার ঘটাপটা কম হয় না।
অঞ্জন কুমার শেঠ
কলকাতা-১৩৬
বৌমার বিয়ে
বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষে ‘শোক-সংস্কার দূরে সরিয়ে বৌমার বিয়ে দিলেন কৃষক দম্পতি’ (১৪-৮) সংবাদটি পড়ে ভাল লাগল। বিদ্যাসাগর নিজের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে এক বিধবা মেয়ের বিয়ে দিলেও সে বিয়ে সুখের হয়নি, নারায়ণচন্দ্রের দুর্ব্যবহারের কারণে। একই রকম দুর্ভাগ্য হয়েছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা কমলার। বঙ্কিমচন্দ্রের মেয়ে শরৎকুমারীর ছোট ছেলে শুভেন্দুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল কমলার। বিয়ের কিছু দিনের মধ্যে শুভেন্দু মারা গেলে আশুতোষ তাঁর মেয়ের আবার বিয়ে দিতে চান। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী এই বিধবাবিবাহের তীব্র বিরোধিতা করেন। অনড় আশুতোষ মামলা করে জিতে মেয়ে কমলার আবার বিয়ে দেন। দুর্ভাগ্য, বছর না যেতেই জামাইটি মারা যান। কমলা আবার বিধবা হন।
এ সব ঘটনা সে দিন রাধাকান্ত দেবের মতো বিধবাবিবাহ-বিরোধীদের হাত শক্ত করলেও, পুত্রবধূর বিয়ে দিয়ে মুকুন্দ মাইতি বুঝিয়ে দিলেন, বিদ্যাসাগরের অভিযান কখনও থামে না।
অরুণকান্তি দত্ত
বেলুড় মঠ, হাওড়া
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।