লকডাউনে সুনসান স্কটল্যান্ডের রাস্তা।
বাংলায় লেখালিখি করার অভ্যেসটা স্কুলের পর থেকেই চলে গেছিল। কিন্তু আজ অনেক দিন বাদে কলম ধরলাম করোনা ভাইরাসের ত্রাসের সৌজন্যে। অনেক বছর হয়ে গেল আমি দেশের বাইরে আছি। প্রথমে পড়াশুনো তারপর কর্মসূত্রে। বর্তমানে আমি স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। থাকি গ্লাসগোর পূর্ব প্রান্তে, পেশায় গবেষক। এপ্রিল মাসের এই সময়, বিশেষত ইস্টারের পর, এখন ঠান্ডা একটু একটু করে কমছে আর খুব সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া চারিদিকে— ঠিক যেমন আবহাওয়ার জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকি। সাধারণ ভাবে এই সময় সূর্য প্রায় রাত সাড়ে আটটা নাগাদ অস্ত যায় বলে দিনের পরিধি অনেক বেশি। আর সবাই এই রৌদ্রোজ্জ্বল দিনগুলো উপভোগ করার জন্য মুখিয়ে থাকে। এই সময় রাস্তাঘাটে লোকজনের ভিড় থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। গাড়ির সংখ্যা এতটাই বেশি থাকে যে, সবসময় পার্কিং পাওয়া যায় না সুবিধে মতো। এমনটাই হতে দেখেছি এতদিন, যেটা এখন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে করোনা ভাইরাসের কারণে। সরকারি নির্দেশ মেনে বিগত একমাসের ওপর আমি ঘরবন্দি হয়ে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছি আর কেবলমাত্র বাজার করার জন্যই বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছি সামান্য সময়ের জন্য। ইমেল, হোয়াটস্যাপ আর স্কাইপের সৌজন্যেই এখন বাইরের পৃথিবীর সাথে আমার একমাত্র যোগাযোগ।
করোনা ভাইরাসের ত্রাসে এখন এখানকার অবস্থা একদম অন্য রকম। এত সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া সত্ত্বেও রাস্তাঘাটে লোকজন, গাড়ি বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সংখ্যা ভীষণই কম। যাঁরা বেরিয়েছেন, তাঁরা হয় দরকারি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত, নয়তো বাজার করতে। তবে কিছু কিছু স্বাস্থ্য-সচেতন লোকজনকে দৌড়াদৌড়ি করতেও দেখেছি মাঝে মাঝে। বেশির ভাগ লোকের মুখেই মাস্ক নেই। কারণ মাস্ক একদমই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কেউ কেউ মুখে রুমাল বেঁধেও ঘোরাফেরা করছেন। কিন্তু সবাই সবার সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন। কেউ কারও সাথে কোনো হাই-হ্যালো পর্যন্ত করছেন না। যেটা এখানে সাধারণ ভাবে ভীষণ অভদ্রতা বলে ধরা হলেও সরকারের নির্দেশে সব্বাইকে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হচ্ছে, যাতে সংক্রমণ না ছড়ায়। এখানে এই সামাজিক দূরত্ব রাখার ব্যাপারটা একদম নতুন। যেটা অনেকেই প্রথম দিকে বুঝতে পারেননি। ফলে সংক্রমণ ছড়াতে সময় লাগেনি। এখন সেটা বুঝলেও মাস্ক না পাওয়া যাওয়ার জন্য লোকজন অন্তত ২ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছে সবসময় যাতে সংক্রমণ কম হয়। আমিও মাস্ক পাই নি। প্রথমদিকে মাস্ক না পরলেও এখন সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ায় নিজের হাতেই মাস্ক বানিয়ে নিয়েছি আর বাইরে বেরোলেই পরছি। আমার সহকর্মীদের মধ্যে ইতিমধ্যেই কয়েকজনের করোনা ভাইরাসের মতো উপসর্গ দেখা গেছিল, তবে কেউই শেষমেশ রোগাক্রান্ত হয়নি, এই যা ভালো খবর।
আজকের তারিখে, যখন এই লেখাটা লিখছি, তখন UK তে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ তিরিশ হাজার আর মৃতের সংখ্যা সতেরো হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই সংখ্যাটা কেবল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লোকজনের, কিন্তু হাসপাতালের বাইরে যারা কেয়ারিং হোমে আছে বা সেলফ-আইসোলেশনে আছে, তাদের সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। শুরুর দিকে গাফিলতির কারণে ভাইরাস ছড়াতে বেশি সময় নেয় নি আর এখন এই সংক্রমণ রোখার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা সবাই মিলে প্রাণপণে লড়াই করলেও অবস্থা সামলানো যাচ্ছে না। রোজ দেখতে পাচ্ছি যে সংখ্যাটা একটু একটু করে বেড়েই যাচ্ছে, না চাইলেও ফোনে সবার সাথে যে কোনো আলোচনাতেই করোনা ভাইরাসের প্রসঙ্গ চলেই আসছে। ইস্টারের পরে এখন সরকারের নির্দেশ যে আরও যেন ন্যূনতম তিন সপ্তাহ সবাই বাড়িতেই থাকে, পরিবার বা বন্ধুদের সাথে কেউ দেখা করতে না যায়, দরকারি কাজ ছাড়া যেন বাইরে না যায়, সবাই যেন ২ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করে আর বাড়ি এসেই যেন সবাই ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলে। তিন সপ্তাহ পরে অবস্থা কি হয় দেখে হয়তো লকডাউনের সময় আরও বাড়ানো হবে, যদিও আমাদের মোটামুটি ভাবে বলা হয়েছে এই লকডাউন অন্তত জুন পর্যন্ত চলবে। ততদিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে হবে, তবে জুলাই মাস থেকেও যে কাজে ফেরা যাবে তা কেউই বলতে পারছে না এখনই।
আরও পড়ুন: গুচ্ছ অভিযোগ তুলে মমতাকে ছ’পৃষ্ঠার চিঠি কৈলাসের, ওঁরা ঈর্ষান্বিত: পার্থ
আরও পড়ুন: লকডাউন উঠলে চালু হবে নিয়ন্ত্রিত বিমান পরিষেবা, দেওয়া হল এক গুচ্ছ নির্দেশিকা
লকডাউনের শুরুর দিকে খুব অসুবিধা হয়েছিল লোকজন প্যানিক বায়িং করছিল বলে। অর্থাৎ সবাই দরকারের অতিরিক্ত জিনিস কিনে বাড়িতে জমা করছিল। বেশিরভাগ দরকারি জিনিস ছিল না সুপারমার্কেটগুলোতে। যেমন চাল, ডাল, আটা, ফ্রোজেন ফুড (মাংস, শাকসবজি), টিস্যু, স্যানিটাইজার সব কিছুই শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে আমাকেও গোটা তিনেক সুপারমার্কেট ঘুরে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হয়েছিল লকডাউনের দুদিন আগে। তখন কেবল মনে হচ্ছিল যে, খাবার না পেলে লকডাউনে চলবে কি করে। তা ছাড়া কোনও অনলাইন ডেলিভারি পাওয়া যাচ্ছিল না যে, অনলাইনে চাল-ডালের অর্ডার দিয়ে রাখা যাবে। সব মিলিয়ে তখন একটু ভয়ই করছিল। এর আগে এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে, বরফ পড়ে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে দিন দুয়েক খাবার-দাবারে টান পড়েছে সুপারমার্কেটগুলোতে। তবে তখন জানতাম, বরফ সরে গেলেই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই অবস্থাটা সম্পূর্ণ আলাদা। জানি না, কবে সুপারমার্কেটগুলোতে সব খাবার-দাবার আসবে আর কখন স্বাভাবিক ভাবে আবার কেনাকাটা করতে পারব। তবে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেয়, এর পরে যাতে কেউ অতিরিক্ত জিনিস না কিনতে পারে। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এখন খাবার-দাবার সবকিছুই পাওয়া যাচ্ছে। যদিও অনলাইন ডেলিভারি কম বলে বেশিরভাগ লোককেই লাইন দিয়ে সুপারমার্কেট থেকে খাবার কিনতে হচ্ছে। তবে কত জন লোক এক সাথে লাইনে দাঁড়াতে পারবে আর কত জন লোক এক সাথে সুপারমার্কেটে ঢুকতে পারবে, তার সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সংক্রমণ রুখতে সবাই এখন এই নিয়মগুলো স্বেচ্ছায় মেনে চলছে।
বিগত দেড় মাস ধরে যে পরিস্থিতিতে আছি, তা প্রথম দিকে চিন্তার কারণ না হলেও যত সময় গড়াচ্ছে, ততই একটু একটু করে চিন্তা বাড়ছে কলকাতায় থাকা আমার পরিবারের জন্য। কলকাতায় আমার পরিবার যেখানে থাকে, তার কাছেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে রেড জোন চিহ্নিত করা হয়েছে। খবর পাচ্ছি, কলকাতায় লোকজন সব জায়গায় লকডাউনের নিয়ম মানছে না। অথচ ব্রিটেনে থেকে যে রকম সংক্রমণ ছড়িয়েছে, তাতে এটুকু তো পরিষ্কার যে, লকডাউন যদি এখানে সময় থাকতে শুরু হত, তাহলে এত লোকজন আক্রান্ত হতেন না বা মারা যেতেন না।
সংক্রমণের শুরুর দিকে, তখনও লকডাউন শুরু হয়নি, কলকাতা যাওয়ার কথা ছিল আমার। কিন্তু ইচ্ছে করেই বাড়ি যাইনি। যদি যাতায়াতের ফলে আমার সংক্রমণ হয় আর তা থেকে আমার পরিবারের লোকজনও আক্রান্ত হন, সেই কথা ভেবে। এখন জানি না আদৌ কবে এই পরিস্থিতি ঠিক হবে। আবার কবে পরিবারের সাথে দেখা করতে পারব। এই ভাইরাসের ওষুধ, টিকা নিয়ে চারদিকে অনেক আলোচনা তো শুনছি। কিন্তু কেউ কোনও প্রকৃত আশার আলো দেখাতে পারেননি এখনও পর্যন্ত। সবার মতো আমিও মনে মনে এটাই চাই যে, সব কিছু যেন আগের মতো ঠিক হয়ে যায় আবার। অন্তত পুজোর সময় যেন কলকাতা ফিরতে পারি।
পরঞ্জয়ী মণ্ডল
গ্লাসগো, স্কটল্যান্ড
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)