সাধারণ মানের স্বাস্থ্য পরিষেবাকে সর্বাধিক ভাবে কাজে লাগিয়ে করোনাকে প্রায় বোতলবন্দী করে ফেলা হয়েছে ভিয়েতনামে। —নিজস্ব চিত্র।
তোমার নাম, আমার নাম, ভিয়েতনাম। যুদ্ধ আজও চলছে।
পতাকার রং টকটকে লাল আর তার মাঝখানে হলুদ তারা। লাল রং রক্তপাত এবং বিপ্লবী সংগ্রামের প্রতীক। হলুদ তারাটি ভিয়েতনামী সমাজের পাঁচটি প্রধান শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। যা হল শ্রমিক, কৃষক, সৈনিক, বুদ্ধিজীবি এবং ব্যবসায়ী। মাথাপিছু দুই চাকার বাহন ব্যবহারে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ভিয়েতনাম। এ দেশের মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। আমি গত তিন বছর কর্মসূত্রে এই দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হো চি মিন সিটি-র বাসিন্দা।
আমার দেখা বিশ্বের বহু শহরের তুলনায় এখানকার মানুষ অনেক বেশি প্রাণচঞ্চল, জীবন্ত। ভোরবেলা থেকে যে শহরটা গমগম করত, রাস্তার ধারে ছোট-ছোট টুলে বসে বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়া আর আড্ডা চলত প্রায় মাঝরাত অব্দি, আজ সেই শহর সম্পূর্ণ নিশ্চুপ, নিঃশব্দ।
আরও পড়ুন: সামনে আসতে চলেছে নিয়ন্ত্রণহীন কুরুক্ষেত্র
বদলে গিয়েছে জীবন নুগেনেরও। অ্যাপ-নির্ভর মোটরসাইকেল চালিয়ে দিনে মোটামুটি দু’লক্ষ ভিয়েতনামি ডং (ভারতীয় মুদ্রায় সাড়ে ছ’শো টাকার মতো) আয় করতো এই বছর আটত্রিশের হাসিমুখের মানুষটি। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা কিছু করেন না , মা-ও সম্পূর্ণ সুস্থ নন। স্ত্রী একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে সেলস গার্ল, বর্তমানে দোকান বন্ধ। দু’টি মেয়ে, বয়স যথাক্রমে ১২ আর আট। মুখের হাসি একটু মলিন হয়েছে বটে কিন্তু এখনও বিলীন হয়নি। “কেমন আছো তোমরা?” জিজ্ঞাসা করতে হেসে বলল, “অনেকগুলো ভাল ব্যাপার ঘটছে স্যার, বাবা আর আগের মতো এটা খাবো-ওটা খাবো বলে চিৎকার করে না। বউয়ের মাইনেটা আগে তো দেখতেই পেতাম না, এখন ও অর্ধেক মাইনে পাচ্ছে কিন্তু সেটা পুরো দেখতে পাচ্ছি। মেয়ে দুটো আগে অনেক কিছু বায়না করতো, এই কদিনেই অনেকটা বড় হয়ে গেল।” মনে মনে ভাবলাম, যে সদানন্দ, তাকে করোনা কী করবে?
১৮ বছরের সুন্দরী কলেজ ছাত্রী হান আর তার ২৩ বছরের বয়ফ্রেন্ড মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সেলস-এ কর্মরত ইয়েনের গল্পটা কিন্তু এতটা আশাব্যঞ্জক নয়। “আচ্ছা, ক্যাফেগুলোকে কি ফিউমিগেট করা যায় না? তা হলে তো আমরা একটু দেখা করতে পারি, একসঙ্গে একটু কফি খেতে পারি। মা-বাবার সঙ্গে আর জাস্ট থাকা যাচ্ছে না।” এক গোছা কালো চুল ঝাঁকিয়ে হানের কথায় একরাশ অস্বস্তি। ইয়েনের এখন বেশ কিছুদিন ছুটি। কোম্পানি বলে দিয়েছে লকডাউনের দিনগুলো মার্কেটে বেরিয়ে সেলসের কাজ করা একেবারে বারণ। “প্রথম কয়েকদিন ভাল লাগলেও এখন খুব বোর হচ্ছি। সারা দিন ঘুরে বেড়ানোটা খুব মিস করছি, আর ইন্সেন্টিভটাও তো পাব না এই দু মাস।” এ বারের জন্মদিনে হানকে নিয়ে সেলিব্রেট করা যাবে না কিন্তু যদি একটা ঠিকঠাক গিফটও না দেওয়া যায় তাহলে তার ফল যে খুব একটা ভালো হবে না তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। তাই ইনসেনটিভ না-পাওয়াটা বেশ বিঁধছে ইয়েনকে।
আরও পড়ুন: লকডাউনের সময় রোজগার হারিয়েছি, সঞ্চয়ও শেষ, সংসার চলবে কী করে?
আমি যে সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টে থাকি, তার রিসেপশনে বসে তিন সুন্দরী। বছর বাইশের লিয়েন, টিনা আর তাদের বস বছর আটত্রিশের জিয়াং। এরা তিনমূর্তি কিন্তু বেশ আছে। করোনা একেবারেই ঢুঁ মারতে পারছে না এদের। জিয়াংয়ের হাতের কুরুশের কাজ বড় ভাল। সারা দিন ফাঁকা রিসেপশনে বসে মনের সুখে কুরুশের জামা, টুপি, এমনকী মাস্ক তৈরি করে চলেছে আর তার দুই শাকরেদ সেই নতুন জামা, টুপি আর মাস্ক পরে মডেল সেজে ফেসবুকে অজস্র ছবি পোস্ট করে চলেছে। অ্যাপার্টমেন্টে লোক বেশি নেই। তাই নেই কাজের চাপ। ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ।
এ দেশের সাধারণ মানুষের কথা অনেক হল। এ বার আসি সরকারের কথায়। পৃথিবীর পঞ্চদশ বৃহত্তম জনবহুল দেশ, জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। প্রধানত মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের বাস এই দেশে। স্বাস্থ্য পরিষেবাও বিশ্বের অন্য দেশগুলোর নিরিখে বেশ সাধারণ মানের। বড় অসুখ হলে এখানকার মানুষজন সিঙ্গাপুরে যায়। কিন্তু যে ভাবে এই দেশটা গত দু’মাস এই অতিমারির মোকাবিলা করল এবং এখনও করে যাচ্ছে, তাকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই। সীমিত পরিকাঠামো নিয়ে সদিচ্ছা আর মনের জোরের উপর ভিত্তি করে যতটা করা সম্ভব, সরকার অনমনীয় দৃঢ়তায় সেই কাজটা করে চলেছে। শহরগুলোকে নিয়মিত ভাবে পরিষ্কার রাখা হচ্ছে, জলের গাড়ি সকাল-বিকেল রাস্তাঘাট ধুয়ে চলেছে। যে সব মানুষ করোনা আক্রমণে কোয়রান্টিনে গৃহবন্দী, তাদের কাছে নিয়মিত ভাবে খাবার, ওষুধ, জল এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছানো হচ্ছে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে। যেখানে বিশ্বের তাবড়-তাবড় দেশগুলোর অবস্থা সঙ্গীন সেখানে এই রকম একটা সাধারণ মানের স্বাস্থ্য পরিষেবাকে সর্বাধিক ভাবে কাজে লাগিয়ে করোনাকে প্রায় বোতলবন্দী করে ফেলা হয়েছে বললে খুব ভুল বলা হবে না। এ যাবৎ এ দেশে করোনা-আক্রান্ত রুগির সংখ্যা আড়াইশোর মতো, প্রায় অর্ধেক রুগি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন, এখন অব্দি মৃত্যুর কোনো খবর নেই। বলতে গর্ববোধ করছি, বিশ্বের প্রথম পাঁচটি নিরাপদ দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম অন্যতম।
আরও পড়ুন: ‘ইনিভিজিবল এনিমি’র কাছে আমরা অসহায়!
শেষে আমার কথা বলি। এই মুহূর্তে এই দেশে আমি একা। স্ত্রী পুত্রের কাছে মুম্বইতে। পুত্র চাকুরিরত, এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কন্যার মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষা মাঝপর্বেই থেমে গিয়েছে। তাই সে অশীতিপর ঠাকুরদা-ঠাকুমার সঙ্গে কলকাতায়। আমি এখানে ‘ফোর্সড ব্যাচেলর’ হয়ে এই ক’দিনে অনেকগুলো নতুন কাজ আয়ত্ত করে ফেললাম। সবজিগুলো বাজার থেকে এনে ধোয়া, তার পর শুকিয়ে ফ্রিজে তোলা, বিভিন্ন সবজিগুলো তরকারির রকমভেদ অনুযায়ী কোনওটা লম্বা, কোনওটা ডুমো করে কাটা, মাছ কাটা আর পরিষ্কার করা। তবে এই সবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল বেশ কিছু বাংলা মেনু রান্না করার অনুশীলন। শেষ এক মাসে কালোজিরে ফোড়ন আর বড়ি দিয়ে লাল শাক, আলু-কুমড়ো-বেগুন দিয়ে পাঁচফোড়নের পুইঁ শাক, লাউ দিয়ে মটর ডাল, লাউচিংড়ি, মাছের কালিয়া, আলু দিয়ে চিকেনের বাংলা ঝোল তৈরি করায় বেশ পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছি।
ধন্যবাদ নিঃসন্দেহে প্রাপ্য আমার মা, সহধর্মিনী এবং অবশ্যই স্কাইপির। বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, বিছানা তুলে ঠিক করাটাও শিখলাম। ঘরের মানুষগুলোর কাজের চাপটা এবার হাতে-কলমে বুঝতে পারছি। এটাও নেহাত কম বড় শিক্ষা নয়। তবে করোনা-পরবর্তী জীবনে শনি-রবিবারে এই নতুন শেখা কাজগুলোর কিছু আমার ঘাড়েও বর্তাতে পারে, সেই ভয়টাও যে নেই, তা বলতে পারি না। অবস্থা যে রকম দাঁড়াচ্ছে লকডাউন আরও মাসখানেক চললে হয়তো নিজের চুল নিজে কাটাও শিখে যাব। এর সঙ্গে চলছে হোয়াটসঅ্যাপ আর জুম-এ আত্মীয়স্বজন, স্কুল আর পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে নিরন্তর আড্ডা। শেষ কবে কাছের মানুষগুলোর সঙ্গে এতক্ষণ সময় কাটিয়েছি মনে পড়ে না।
করোনার এই ভয়াবহতার মধ্যেও অনেকগুলো নতুন জিনিস শেখা হল। অনেকগুলো পুরনো সম্পর্ক আবার ঝেড়েপুঁছে পরিষ্কার করা হল। ছেলের মা আর নাতনির দাদু-ঠাকুমাদের মনও বেশ ফুরফুরে। কারণ ভালোবাসার লোকগুলোর সঙ্গে এতগুলো দিন একসঙ্গে থাকতে পারাটা পড়ে পাওয়া ‘চোদ্দআনা’। ভাইরাসহীন দিন ফিরলে আমরা যে-যার মতো আবার নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। করোনার কারণে একসঙ্গে কাটানো আনন্দঘন এই মুহূর্তগুলো থেকে যাবে সবার মনের মণিকোঠায়, আজীবন। এটাও কি কম পাওয়া?
অনির্বাণ বসু , হো চি মিন সিটি, ভিয়েতনাম
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)