‘অমুকবাবু ঘুষ খান না। কত টাকা পর্যন্ত উনি সৎ সেটা তো জানবেন!’ বিভিন্ন অফিসে গিয়ে কার্যোদ্ধারকারী কর্মীর প্রতি মালিকের এমন উপদেশের কথা মনে পড়ল স্বপ্নেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গুছিয়ে নেওয়ার পূর্ণগ্রাস’ (১১-৭) পড়ে। একই দিনের খবর, একটি রাজ্যে বিধায়কদের কিনতে একটি রাজনৈতিক দল বিধায়ক-পিছু দর দিয়েছিল ৪০ কোটি টাকা (‘বিজেপি দল ভাঙাচ্ছিল গোয়ায়, দাবি কংগ্রেসের’)। বড় সর্বনাশের ইঙ্গিতবাহী এই সব বৃত্তান্ত। শিরদাঁড়া কেনা-বেচা করে যে যার আখের গোছানোর চেষ্টা করছেন অনবরত। সর্বস্তরে কাজ করছে নীতিহীনতা, যেখানে যার যতটা ‘সুযোগ’ আছে, সে তা গ্রহণ করবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে এই ভারসাম্যহীন নীতিহীনতার প্রতিফলন ঘটেছে। যা হওয়ার ছিল তা-ই হচ্ছে। বিষবৃক্ষে বিষফল ফলছে।
নতুন যা জানা গেল, উন্নতিশীল সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাকি অল্পস্বল্প ‘ইধর-উধর’ চলেই। অর্থনীতিতে একে ‘সামান্য’ দুর্নীতি বলা হয়, যা ‘র্যাশনাল’ বা যুক্তিসঙ্গত চ্যুতির পর্যায়ে পড়ে। এতে নাকি কাজকর্ম এবং অর্থনীতিতে গতি আসে। ‘প্লিজ়-মানি’ বা ‘গ্রিজ়-মানি’ যা-ই বলুন, আর একটু আরামে বাঁচার জন্যে সেইটুকু লেনদেন বাস্তববাদিতার পর্যায়ে পড়ে— এমন কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় প্রতিবেদনটি পাঠ করার সময়। বলা হচ্ছে, সমাজের পক্ষে এই খুচরো দুর্নীতি মঙ্গলদায়ক। অর্থনীতির তাত্ত্বিক গবেষণায় নাকি এমন ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে।
সাধারণ পাঠকের কাছে বিষয়টি সহজবোধ্য নয়। একটু পুস্তক-ঘেঁষা শিক্ষায় আমরা যেটা জেনে এসেছি তা হল, সমাজের বুকে ছোট-বড় যে কোনও দুর্নীতি হল কর্কট রোগাক্রান্ত কোষের শামিল। সেগুলো বেড়েই চলে। সময় থাকতে যদি তাকে সমূলে বিনাশ না করা যায়, তবে স্বাভাবিক গতিতে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে মৃত্যুই আক্রান্তের স্বাভাবিক পরিণতি। সমাজের ক্ষেত্রে দুর্নীতি সেই কর্কটকোষ। তার পরিমিত অনুপ্রবেশে কী করে ইতিবাচক ফল লাভ হতে পারে? প্রচলিত ধারণার সঙ্গে এ কথা মেলে না।
বিশ্বনাথ পাকড়াশি
শ্রীরামপুর, হুগলি
অসম্মানিত
‘গুছিয়ে নেওয়ার পূর্ণগ্রাস’ শীর্ষক প্রবন্ধে শিক্ষক নিয়োগ-সংক্রান্ত দুর্নীতি, এর পরিণাম এবং অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে সামগ্রিক রাজনীতির দুর্নীতিপরায়ণতা নিয়ে বিশ্লেষণ অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত হয়েছে। কৌশিক বসু এই পত্রিকার পাতায় একদা লিখেছিলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার স্কুলশিক্ষকদের বেতন দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশের চাইতে বেশি। তাই ভাল ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতার পেশায় আসেন এবং তার সুফল পরবর্তী প্রজন্ম পায়। এই যে এক প্রজন্মের গণ্ডি ছাপিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তার সুফল পৌঁছে যায়, অর্থনীতির ভাষায় একে ‘পজ়িটিভ এক্সটার্নালিটি’ বা ইতিবাচক অতিক্রিয়া বলা হয়। বাংলায় শিক্ষকদের সম্মান থাকলেও উপযুক্ত সাম্মানিক ছিল না। বুড়ো রামনাথ বা প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের কথা সাহিত্যে বার বার উঠে এসেছে। বাম সরকারের আমলে শিক্ষকতার উপযুক্ত সম্মানদক্ষিণা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়, শিক্ষকতার পেশা ভাল ছাত্রছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সে সময় স্কুল ম্যানেজিং কমিটি বা বকলমে পার্টির সুপারিশে স্বজনপোষণ হয়নি, এ রকম দাবি অতি বড় বাম সমর্থকও করবেন না। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে স্কুলশিক্ষা ও শিক্ষক নিয়োগই বাম সরকারের কাছে প্রাধান্য পেয়েছিল, জুতো, ব্যাগ প্রভৃতি উপলক্ষের ভিড় লক্ষ্যকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। সম্ভবত লখিন্দরের বাসর ঘরের ছিদ্র বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ১ এপ্রিল, ১৯৯৭ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রতিষ্ঠা, এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বছর বছর শিক্ষক নিয়োগের আয়োজন।
তথাকথিত ‘অনিলায়ন’-এর মিথ ভেঙে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মা-মাটি-মানুষের সরকার রাজ্যের শাসনভার হাতে নিয়েছিল। স্বজনপোষণ, দুর্নীতির কারণে ‘পজ়িটিভ এক্সটার্নালিটি’-র পরিবর্তে ‘নেগেটিভ এক্সটার্নালিটি’ আবাহন করে এনেছে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের সর্বনাশের সূচনা করেছে। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, বর্তমান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, পর্ষদ সভাপতি, উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্যদের দরজায় সিবিআই কড়া নাড়ছে, বিচারপতির রায়ে শিক্ষক চাকরি হারাচ্ছেন, মন্ত্রী-কন্যা দুই কিস্তিতে বেতন ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এই সময়কালে চাকরিপ্রাপ্ত সকল শিক্ষকের সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের ব্যর্থতা। ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপনে শিক্ষক ব্রাত্য হয়ে গিয়েছেন।
তবে ‘দুর্নীতি, সামাজিক অবক্ষয় ও সুবিধাবাদকে আমরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছি’— লেখকের এই মন্তব্যের সঙ্গে পূর্ণ সহমত হওয়া গেল না। শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সরকারের মুখ পোড়ে না।
রাজশেখর দাস
কলকাতা-১২২
দুরারোগ্য
স্বপ্নেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি সময়োপযোগী এবং তাৎপর্যপূর্ণ। দেশ, রাজ্য ও সমাজে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে যে ভাবে দুর্নীতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং তাঁদের অভিভাবকরা বড়ই চিন্তিত। প্রায় সমস্ত দফতরের নিয়োগ প্রক্রিয়া, যেমন— শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বন ও বন্যপ্রাণী, শিল্প ইত্যাদি— আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে। তা হলে আজকের ছাত্রছাত্রীরা, যাঁরা কঠোর পরিশ্রমে পড়াশোনা করে একটা চাকরির আশায় দিন গুনছেন, তাঁদের মনের অবস্থা কী হতে পারে? কোনও রাজনৈতিক দল চিরদিন ক্ষমতায় থাকে না, থাকবেও না। কিন্তু নিয়োগের যে পদ্ধতি চালু হয়ে গেল, সেটা চাকরিপ্রার্থীদের অবশ্যই ভাবিয়ে তুলবে। এমনিতেই রাজ্য এবং দেশে কর্মসংস্থানের অভাব। যা আছে তা-ও বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। যেটুকু সুযোগ আছে, সেখানেও যদি দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণ চলতে থাকে, তা হলে বেকার যুবক-যুবতীরা কোথায় যাবেন? লেখক তাঁর প্রবন্ধের শেষে উল্লেখ করেছেন, অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে এক জন একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষে জায়গা পান, এবং নেতা বা মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ হয়। এই ক্ষমতা থাকাকালীন নিজের এবং আত্মীয়-স্বজনের ভবিষ্যতের জন্য যা করার, তিনি তা করেন। আগেও যে এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল, তা নয়। তবে তুলনায় অনেকটাই কম। সুতরাং, নেতা-মন্ত্রীরা সৎ না হলে এই দুর্নীতির রোগ সারানো কঠিন।
স্বপন আদিত্য কুমার
অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
বিকল্প কই
প্রায়শই স্কুল-কলেজে সিলেবাস শেষ হওয়া, না-হওয়া নিয়ে লেখা দেখি। শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্তদের কাছে প্রশ্ন, সমগ্র সিলেবাস শেষ করা কি আদৌ সম্ভব, নির্ধারিত শিক্ষাবর্ষে? কোনও দিন কি সেটা হত?
কলকাতা, মফস্সলের স্কুল-কলেজ থেকে আশি-নব্বইয়ের দশকে পড়াশোনা করেছি। ক্লাসের উপর নির্ভরতা কতটুকু রাখা উচিত ও সম্ভব, সেটা ভালই জানা আছে। সিলেবাসের বোঝা বিশাল, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের শিক্ষাদানের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ আছে। তার উপর ক্লাসের ছাত্রদের পারস্পরিক মানে আকাশপাতাল পার্থক্য। সুতরাং, ক্লাস-নির্ভরতা যে একটি আকাশকুসুম, তার প্রধান কারণ সম্ভবত এগুলোই। এই প্র্যাক্টিক্যাল কারণগুলোকে হজম করে, সংসারের বাজেটের উপর চাপ সৃষ্টি করে প্রাইভেট টিউশনের উপর নির্ভরতাটাই বাস্তব। আমাদের এলাকায় অধিকাংশ সময় ভাল গৃহশিক্ষক পাওয়া যেত না, সেটা অতিরিক্ত অসুবিধা।
বর্তমানে বাংলার শিক্ষা কোথায় দাঁড়িয়েছে, সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোই তার সাক্ষী। সেখানে অবস্থা কিছু পাল্টাবে, এটা আশা করা ভুল। তাই গৃহশিক্ষকতাই পথ। স্কুলের শিক্ষকরা কোচিং করলে স্থানীয় ছাত্ররা উপকৃতই হচ্ছে, হবে। মনে হয় না, এর বিকল্প আছে।
কৌশিক দাস
বেঙ্গালুরু