Anna Sebastian Perayil Death

সম্পাদক সমীপেষু: টিকে থাকার যুদ্ধ

২৬ বছরের তরুণী সবে এক সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু কর্মদাতা, সমাজ, রাষ্ট্র, সহকর্মী কেউ তাঁর দায়িত্ব নিতে চাইল না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৪ ০৬:৪৭
Share:

আনা সেবাস্টিয়ান পেরিলের অকাল ও অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রসঙ্গে ঈশা দাশগুপ্ত তাঁর ‘জীবনসংহারী কর্মক্ষেত্র’ (৬-১১) প্রবন্ধে যথার্থ লিখেছেন, “শ্রমের বাজারের তত্ত্ব, মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার চেষ্টা, বাড়ির লোকের স্নেহ কিছুতেই কমাতে পারেনি তার মনের কালিমা।” ২৬ বছরের তরুণী সবে এক সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু কর্মদাতা, সমাজ, রাষ্ট্র, সহকর্মী কেউ তাঁর দায়িত্ব নিতে চাইল না। আসলে সাধারণ ভাবে জীবন ও জীবিকা ক্ষেত্রে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, জগৎ-সংসার ইত্যাদি বিগত অর্ধ শতাব্দীতে অভাবনীয় ভাবে বদলে গিয়েছে। বিশেষ করে শ্রম-উৎপাদন ক্ষেত্র, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য মাধ্যম, এই তিন জায়গায় যাবতীয় ব্যক্তি মানুষ, গোষ্ঠী একে অপরকে জ্ঞানত বা অজ্ঞানত এমন কিছু পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা আগে ভাবা যায়নি এবং যা থেকে উল্টো দিকে ফেরা অসম্ভব। ব্লু-কলার/হোয়াইট-কলার, শ্রমিক/কৃষক/পরিষেবা কর্মী, খুচরো ব্যবসায়ী/কর্পোরেট সেক্টর ইত্যাদি সবাই এই পরিস্থিতিতে অল্পবিস্তর আক্রান্ত, বিপর্যস্ত। ভাবনার কথা, কোনও একক বা জোটের রাজনৈতিক পথ, আদর্শ এবং কর্মসূচি সেই আক্রান্তদের স্বার্থ দেখার চেয়ে নিজেদের স্বার্থ আগলানোই পছন্দ করছে।

Advertisement

১৯৮০-২০২০ সালের মধ্যে কাজ করেছি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে। দিনে ৮ ঘণ্টার শ্রমের পর যথেষ্ট অবকাশ মিলত প্রগতিশীল সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার কাজে। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের চরিত্র বদল হতে লাগল। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দুর্বলতা প্রকাশ পেল। প্রতিযোগিতার নামে উদার বাজারব্যবস্থা আগ্রাসী নেতিবাচক পথ নিল। বোঝা যাচ্ছে পুঁজিবাদ, ধনতন্ত্র অনেক সবল ক্ষমতাশালী হয়ে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, কিন্তু তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। যা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সেই ‘কাজ’-এর চাপের যেন শেষ নেই। শিল্প-প্রযুক্তি বিপ্লব, কম্পিউটার-ডিজিটাল বিপ্লব— একের পর এক আক্রমণের ঢেউ আছড়ে পড়ছে জীবন-জীবিকায়। কোভিড নতুন আক্রমণ হানল, যেখানে কাজের সময়সীমা নেই, কোথাও কাজ আছে কিন্তু ভার্চুয়াল ডিজিটাল পরিকাঠামোয় কাজের জায়গা কার্যত নেই। বিশ্বজোড়া কর্মযজ্ঞে এটাই নির্মম সত্য। এখন ব্যাঙ্কে গেলে দেখি বর্তমান সহকর্মীদের মন, মেজাজ, আচরণ আগের মতো সহনশীল নয়। কাজের চাপে গ্রাহক বা সহকর্মীর মন্তব্য, ব্যঙ্গ সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না।

এর ফলে গ্রাহক, কর্মী সংগঠন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক, এমনকি নিজের পরিবারিক, সামাজিক সম্পর্ক আর সুস্থ স্বাভাবিক থাকছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে এই পৃথিবীতে এ ভাবে মানসিক রোগী আরও বাড়বে। অতএব প্রবন্ধকারের পরামর্শ অনুযায়ী ‘কালিমা’ সারাতে এক দিকে আক্রান্ত ব্যক্তির নিজের সাধ ও সাধ্যের সঙ্গে লড়াই জারি থাকবে, অন্য দিকে তার চার দিকে ব্যবস্থার বদলের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে তাকেই।

Advertisement

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

সুস্থ পরিবেশ

কর্মক্ষেত্রে বিষাক্ত পরিবেশ বিষয়ক ঈশা দাশগুপ্তের প্রবন্ধের প্রতি সমর্থন জানিয়ে দু’-একটি দিক তুলে ধরতে চাই। এক জন চাকরিজীবী মানুষ তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটান কর্মক্ষেত্রে। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুসারে ভারতের ৮৬% মানুষ বিরক্তিকর চাপের মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হন। পরিণতিতে সব ক্ষেত্রে মৃত্যু না ঘটলেও ঘটছে বিপুল ক্ষতি। স্বীকার করতেই হবে, কাজের জায়গায় চাপমুক্ত আনন্দময় পরিবেশ বজায় রাখতে পারলে সম্পাদিত কাজের মান এবং পরিমাণ দুই-ই বাড়বে, যার সুফল সংশ্লিষ্ট সকলে ভোগ করতে পারেন। অথচ দায়িত্বশীল উপরওয়ালা অনেক সময় এই সহজ বিষয়টি বুঝতে চান না বা পারেন না। অনেক সময় আধিকারিক বা সুপারভাইজ়ররা তাঁদের উপরওয়ালা-প্রদত্ত মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন, যা তাঁরা সঞ্চারিত করেন তাঁদের অধীনস্থ কর্মীদের মধ্যে। অনেক সময় আবার সমপর্যায়ের কর্মীরা উপরওয়ালাদের খুশি রাখেন নিজের আখের গোছানোর তাগিদে। আরও একটি দিক এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য— লিঙ্গভিত্তিক অবমাননা। কোনও কোনও কর্মক্ষেত্রে পুরুষ কর্মচারী অবস্থানগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে মহিলা কর্মচারীদের সঙ্গে আপত্তিকর ব্যবহার করেন। মহিলা কর্মচারী যদি অস্থায়ী বা এজেন্সির কর্মচারী হন, তা হলে নির্যাতনের সম্ভাবনাও বাড়ে।

কর্মক্ষেত্রের অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটিগুলিকে সক্রিয় রাখতে হবে। শুধু যৌন নির্যাতন নয়, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে প্রতিষ্ঠানের সব কর্মচারীর মানসিক ক্লেশের প্রতিবিধান খুঁজতে হবে কমিটিকে। তাদের সুপারিশ সাধারণ ভাবে মানতে বাধ্য থাকবেন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। প্রয়োজনে বর্তমান আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। কমিটির সদস্যরা যাতে নিয়মিত মিলিত হন এবং তাঁদের সামনে যাতে প্রতিটি খুঁটিনাটি আলোচিত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অস্থায়ী কর্মীদের জন্য গড়তে হবে জেলাস্তরে কমিটি। প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও সর্বস্তরে সচেতনতাই পারে কর্মক্ষেত্রে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে।

বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি

শ্রমের অপচয়

‘জীবনসংহারী কর্মক্ষেত্র’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে জানাতে চাই, বর্তমান কর্মক্ষেত্রে বিশেষত বেসরকারি ক্ষেত্র, ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য কিছু সংখ্যক সংস্থায় কর্মী-সংখ্যা কমিয়ে স্বল্পসংখ্যক কর্মীদের উচ্চ বেতন দিয়ে যে পরিমাণ চাপ দেওয়া হয়, তা সত্যিই অমানবিক। কর্মী ইউনিয়ন চাইলেও আইন অনুযায়ী কর্মী নিয়োগ না করে চুক্তিভিত্তিক স্বল্প বেতনে কর্মী নিয়োগ একটি অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। যার পরিণতিতে সেই কর্মীদের অত্যধিক চাপে কাজ করতে বাধ্য করা হয় এবং তাঁদের সব সময়ে চাকরি চলে যাওয়ার দুশ্চিন্তা, নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি অমনোযোগিতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। নিত্য এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করে এক জন কর্মী কত দিন তাঁর মেধা ও নিষ্ঠার বিনিময়ে শারীরিক ভাবে সুস্থ থেকে পরিষেবা দিতে পারবেন? এই সমস্যার সমাধানে সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কারও কোনও হেলদোল নেই। নতুন উদ্যমী শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের কি নিয়োগ করা যায় না রেল, পুলিশ ও অন্যান্য সরকারি দফতর, ব্যাঙ্ক এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে? এতে তো দেশের বেকারত্বের সমস্যারও কিছুটা সমাধান হতে পারে। ১৪১ কোটির দেশে শিক্ষিত এবং মেধাসম্পন্ন যুবক-যুবতীদের শ্রমকে কী ভাবে বিনষ্ট করা হচ্ছে, ভাবলে বিস্ময় লাগে।

সুব্রত সেন গুপ্ত, কলকাতা-১০৪

শুধুই লক্ষ্যপূরণ

ঈশা দাশগুপ্ত কর্মক্ষেত্রে অসহনীয় পরিবেশের কারণে কর্মচারীদের মানসিক রোগ বা অবসাদ, এমনকি মৃত্যুর কথা যথার্থই বলেছেন। আসলে নিয়ামক সংস্থাগুলো যে ‘টার্গেট’ শব্দটিকে বেছে নিয়েছে, তা কর্মক্ষেত্রের অসহনীয় পরিবেশ তৈরির পক্ষে যথেষ্ট। ‘টার্গেট’ পূরণ করতে কর্মচারীদের সক্ষমতার শীর্ষে গিয়েও সারা ক্ষণই দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। ইদানীং ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে প্রায় দশ ঘণ্টারও বেশি সময় কাটাতে হয় অফিসারদের। ব্যক্তিগত পরিসরের জায়গাটুকুও চলে যাচ্ছে। নিত্যনতুন কর্মপদ্ধতি আর সার্কুলার-এর কারণে দিশাহারা কর্মজীবন। ব্যাঙ্কগুলিতে ঋণ বা অ্যাকাউন্ট খোলার টার্গেট, উৎপাদনভিত্তিক দফতরগুলিতে উৎপাদনের টার্গেট, রাজস্ব আদায়কারী অফিসগুলিতে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ইত্যাদি। অসহনীয় কাজের চাপের সঙ্গে উপরওয়ালার খারাপ ব্যবহারও যুক্ত হয়। এর সঙ্গে কারও পারিবারিক জীবনে অশান্তি যুক্ত হলে সেই কর্মচারীরা অবসাদের শিকার হন। কর্মী যাতে সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ পান, নিয়োগক্ষেত্রগুলিকে নিশ্চিত করতে হবে।

স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement