সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় রাজ্যের বিভিন্ন দফতরের অবসরপ্রাপ্ত সেতু বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। ফাইল চিত্র।
গুজরাতের মোরবীতে ঝুলন্ত সেতু বিপর্যয়ে শতাধিক প্রাণের বিসর্জন থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। এ রাজ্যের সমস্ত পুরনো সেতু, কালভার্ট, উড়ালপুল, এমনকি পঞ্চায়েতের অধীন খালের উপর তৈরি বাঁশ-নির্মিত ছোটখাটো যাতায়াতের মাধ্যমগুলির স্বাস্থ্য অবিলম্বে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষা করতে হবে। কোনটিতে ছোটখাটো মেরামতি হলেই চলবে, কোনটির বড় রকম সংস্কার দরকার, বা কোনটি যান চলাচলের একেবারেই অযোগ্য, নতুন সেতু নির্মাণের প্রয়োজন আছে ইত্যাদি জানাতে ইঞ্জিনিয়ারদের প্যানেল নিযুক্ত হোক। তবে যাঁদের দিয়েই এই অতি স্পর্শকাতর কাজগুলো করানো হোক না কেন, তাঁদের যেন এই কাজে প্রচুর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকে, এটা আগে নিশ্চিত করতে হবে। কোনও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বা কোনও প্রতিষ্ঠিত সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা হতে পারে। এমনকি রাজ্যের বিভিন্ন দফতরের অবসরপ্রাপ্ত সেতু বিশেষজ্ঞদের সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ও কারিগরি দক্ষতার সাহায্য নেওয়া উচিত। বিশেষ প্যানেল যে নির্মাণগুলিকে অযোগ্য ঘোষণা করবে, সেগুলো মানুষ বা যান চলাচলের জন্য খুলে রাখা উচিত হবে না। একটি সাময়িক বাইপাস তৈরি করে বা খাল বা নদীর উপর ফেরি চলাচলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
গ্রামীণ এলাকায় সরকারি কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এখনও খালের উপর বাঁশের কিছু নড়বড়ে অস্থায়ী সেতু তৈরি করেন স্থানীয় মানুষ, সাইকেল বা রিকশা চলাচল করতেও সেগুলো ব্যবহার হয়। এগুলি অত্যন্ত বিপজ্জনক, অবিলম্বে বর্জন করে সেতু বা কালভার্ট করে দেওয়া উচিত। আক্ষেপ, সেতু-কালভার্ট তৈরির কাজ খানিকটা করে মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া আমাদের এক রকম স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।
মনে রাখতে হবে যে, এই সমস্ত সেতু, উড়ালপুল, কালভার্ট ইত্যাদি যান চলাচলের সামগ্রিক পরিকাঠামো রাজ্যের বিভিন্ন দফতর— যেমন পূর্ত, কেএমডিএ, কলকাতা পুরসভা ও অন্যান্য মিউনিসিপ্যালিটি, পঞ্চায়েতের অধীনে আছে। তাই প্রত্যেকটি সংস্থার উচিত হাতে হাত মিলিয়ে কাজে লেগে পড়া। এ ব্যাপারে শিথিলতা বরদাস্ত করা উচিত নয়। তবে সেতুর ব্যবহারযোগ্যতা সম্পর্কে শেষ সিদ্ধান্ত সরকারের অধীনে সংস্থাগুলিরই নেওয়া উচিত। কোনও মতেই বেসরকারি সংস্থার উপরে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়, যা মোরবীর ক্ষেত্রে ঘটেছে।
যে-হেতু সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও মেরামতি বেশ জটিল ব্যাপার, তাতে যথেষ্ট সময় লাগতে পারে, তাই মানুষকে একটু ধৈর্য ধরতেই হবে।
মৃণাল মুখোপাধ্যায়, প্রাক্তন মুখ্য স্থপতি, রাজ্য পূর্ত দফতর
দুর্নীতির ফল
মোরবীতে মচ্ছু নদীর উপর ব্রিজ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে গুজরাত সরকার এবং স্থানীয় পুরসভার মধ্যে শুরু হয়েছে এক অদ্ভুত চাপানউতোর। রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি বলছেন, ব্রিজ রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় দায় পুরসভার। পুরসভার প্রতিনিধি বলছেন, ‘নব নির্মাণ’-এর পর পুরসভার ‘ফিট’ সার্টিফিকেট ছাড়াই সেতুটির উদ্বোধন হয়ে গেছে। এই সব তরজা শুনে দু’তরফের প্রতি কিছু প্রশ্ন ওঠে। যেমন, উপযুক্ত শংসাপত্র ছাড়াই, পুরসভার নাকের ডগায়, উৎসবের প্রাক্কালে জনসাধারণের জন্য রাজ্য প্রশাসন ব্রিজটি খুলে দিল কী করে? সর্বাধিক ১২৫ জনের জায়গায় ৩৫০ জন টিকিট কেটে উঠে পড়লেন কী ভাবে? কারা টিকিট বিক্রি করলেন? ঘড়ি-বাল্ব নির্মাণকারী একটি সংস্থা হঠাৎ করে একটি সেতু সারাই এবং রক্ষণাবেক্ষণের বরাত পেয়ে গেল কোন মন্ত্রবলে?
তবে, পোস্তা থেকে মাঝেরহাট, সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনা দেখতে দেখতে আমাদেরও এই উপলব্ধি হয়েছে যে, এগুলি আসলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থায়, এবং সরকারি ছত্রছায়ায় থাকা বেসরকারি সংস্থাগুলিতে দুর্নীতির যে নিবিড় অনুশীলন চলছে প্রতিনিয়ত, এই ধারাবাহিক দুর্ঘটনাগুলি তারই ফল। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা কেবল প্রহসন, যার কার্যকারিতা আসলে শূন্য। দরকার মানসিকতা ও মূল্যবোধের আমূল পরিবর্তন।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘটনাটি ঘটার সময় গুজরাতে উপস্থিত ছিলেন। তৎসত্ত্বেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনি ঘটনাস্থলে হাজির হতে পারেননি! কী করছিলেন উনি? বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন, শিলান্যাস ইত্যাদি। অথচ, তখন রাজ্যে চলছে মৃত্যুমিছিল। আরও যা উদ্বেগের তা হল, এই ঔদ্ধত্য ছোঁয়াচে। সেই কারণেই বরাত-পাওয়া কোম্পানির ম্যানেজার দীপক পারেখ শতাধিক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুকে নির্লজ্জ ভাবে ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’ বলে চালিয়ে দিতে চান। জয়সুখভাই পটেলের সংস্থার উচ্চ পদাধিকারীর বক্তব্য শুনে এমনও ভ্রম হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, মাঝে মাঝে কিছু সেতু ভেঙে পড়তেই পারে, এতে ‘উন্নয়ন’-এর কোনও দোষ নেই। প্রশ্ন জাগে, সত্যি কি বর্তমানে একটি সভ্য দেশের নাগরিক আমরা?
সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
ভোলবদল
‘রাতারাতি রং করা হাসপাতালে মোদী’ (২-১১) শীর্ষক সংবাদের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। গুজরাতের মোরবীতে ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর হতাহতদের পরিবারের কাছে কোনও সান্ত্বনা বাক্যই যথেষ্ট নয়। আহত ব্যক্তিদের যে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, সেই হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী যাবেন বলে তড়িঘড়ি তার হাল ফেরানোর ব্যবস্থা যদি করা হয় প্রশাসনের তরফে, তবে সন্দেহ হয় যে, নিজেদের অপদার্থতাকে আড়াল করতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সেই রাজ্যের প্রশাসন। খবরে প্রকাশ, ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের প্রবেশের ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবুও অকুতোভয় যে সাংবাদিকদের আপ্রাণ চেষ্টায় আমরা মোরবীর দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত খবরাখবর পেয়েছি, তার জন্য অবশ্যই বাহবা প্রাপ্য। আসলে সাংবাদিক কিংবা লেখক-লেখিকাদের নিয়ন্ত্রণ করলেই যে সব ব্যর্থতাকে আড়াল করা যায় না, মোরবীর ঘটনাটির ক্ষেত্রে সেই সত্যই আর এক বার প্রতিষ্ঠা পেল। ভারতের আইনি ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রেখেও বলতে হয়, নির্মম এই ঘটনাটির তদন্তের জন্য কমিটি গঠন, তার তদন্ত এবং শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি কী হবে, তা তদন্তকারী সংস্থা যেমন জানে, তেমন প্রশাসনেরও সম্যক ধারণা আছে। আমজনতার স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করার কোনও ‘টনিক’ আজ অবধি আবিষ্কৃত হয়নি বলেই দ্রুত মোরবীর ঘটনাটি বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে।
গুপ্তিপাড়া, হুগলি
শ্রদ্ধাশীল
জনগণের করের টাকায় দেশের নানা স্থানে মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, অথচ উন্নত সেতু নির্মাণ, রেল পরিষেবার উন্নতি, অর্থাৎ যে সব কাজে জনসাধারণের প্রকৃত উন্নতি সাধিত হয়, সেখানে সরকার দায়সারা, উদাসীন। ওরেভা সংস্থার বরাত পাওয়া, ও ভোটের আগে তাড়াহুড়ো করে সেতুটি মেরামত করে ছেড়ে দেওয়া, পুরো বিষয়টির মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। কিন্তু আশঙ্কা হয়, কিছু দিন হইচইয়ের পর প্রকৃত অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যাবে। আসলে ধর্ম, নৈতিকতা, সততার বাণী শুধু মুখেই বলা হয়, আচরণে নয়। তবে ভাল দৃষ্টান্তও রয়েছে। অরবিন্দ কেজরীওয়াল মানুষের সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, উন্নত সেতু নির্মাণ ইত্যাদির সুব্যবস্থা করেও সাংসদ-বিধায়কদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধার কিছুটা যাতে জনগণকে দিতে পারেন, নানা খাতে খরচ বাঁচিয়ে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। তেমন ভাবেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন নবীন পট্টনায়ক, ওড়িশার জন্য। দেশের প্রকৃত শ্রদ্ধাশীল নেতা হচ্ছেন তাঁরাই, যাঁরা সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা সবার আগে ভাবেন, তাঁবেদার শিল্পপতিদের কথাতে ওঠবস করেন না।
কাঁচরাপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা