কোনাকাটার জন্য বাজারে উপচে পড়েছে ভিড়।
শারদোৎসব দরজায় কড়া নাড়ছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয় এবং তার থেকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার ভ্রুকুটি ছাপিয়ে এখন চোখে পড়ছে বাজারে বাজারে পুজোর ভিড়। অবিন্যস্ত এই ভিড়ে বর্তমান সময়ের প্রয়োজনমাফিক শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার যে স্বাস্থ্যবিধি আমাদের এখনও মেনে চলা জরুরি, তাকে প্রায় ধুত্তোর করে ‘করোনা অনেক হল, এখন তো পুজোটা হোক’ বলতে বলতে পথ চলছেন অনেকেই। চোখে দেখলে মনেই হবে না যে, আকাশে এখনও আছে করোনার কালো মেঘ। দুশ্চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায় ফি-বছরের মতো মণ্ডপসজ্জার চোখধাঁধানো উদ্যোগের মধ্যে। ফাল্গুন মাস থেকে চলতে থাকা দুঃখের মধুচন্দ্রিমা সরিয়ে দুম করে বেরিয়ে আসার একটা যেন সুযোগ পাওয়া গিয়েছে। দমবন্ধ শঙ্কা আর ভয়ের পথ হাঁটতে হাঁটতে অনেকেরই মনে চলে আসছে কিছুটা ক্লান্তি, অনেকটা অবসাদ আর বেশ কিছুটা বেপরোয়া ভাব। এই সব মিলিয়ে রাস্তায় দলবদ্ধ হুল্লোড়ের যে ছবি এখনই চোখে পড়ছে, তাতে চারপাশে চলতে থাকা অসুস্থতা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
এই শরতেও বাঙালির মনে অবশ্যই আনন্দের মেঘ ভাসবে। অনেকের কষ্টে কাঁপতে থাকা বুক আর হাত নিয়ে ঢাকে কাঠি এবারও পড়বে। কিন্তু যেটা আমাদের প্রত্যেকের মাথায় থাকা দরকার— আহ্লাদের আতিশয্যে ডুবে গিয়ে যদি বড় প্রেক্ষিতটা ভুলে যাই, তবে চার দিনের আনন্দোৎসব আরও অনেক প্রলম্বিত এবং গভীর দুঃখ আর অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ জীবনের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠবে অচিরেই। ‘আর পারছি না, একটু হোক’ বলতে বলতে
দুঃখের বন্ধ দরজাটা হাট করে খুলে রাস্তায় নামা— প্রায় কোনও বিধির তোয়াক্কা না করে জীবনের যে দোলা মহানগরে লাগল, তাতে দেশান্তরেও উদ্বেগ বাড়ছে। কালান্তরের পথিক বাঙালি প্রজাতি যদি সময়ের শৃঙ্খলার প্রয়োজনের সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে না পারে, তা হলে তা আমাদের কালজয়ী ঐতিহ্যের সঙ্গে তাল মেলানোর বদলে আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে না তো? এ দেশের অন্যান্য রাজ্যের অভিজ্ঞতাও সেই বার্তাই দিচ্ছে। আর তাই আমাদের এই বিনম্র আকুতি।
এ কথা সত্যি যে, ভাইরাসের ভয়ে দরজায় খিল লাগিয়ে ঘরের কোণে বসে থাকলে মনে ঝিমুনির পরশ লাগে। কত মানুষের টান পড়ে পেটে, আগুন জ্বলে বেশ কিছু কষ্টে থাকা জীবনে, বহু মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার এটাও সত্যি যে, জৈবিক প্রলয়ের মধ্যে পড়ে অনুশাসনের বেড়াজালে নিজেদের ঢেকে রেখে দেশ ও রাজ্যের মানুষ এত দিন যে পথ হাঁটছেন, তাতেও কিন্তু অনেকটা সাফল্য এসেছে। আরও বড় দুর্ঘটনা এবং বিপদ হতে পারত। সেটাকে আটকানো গিয়েছে। এই সময়ে যদি আমাদের জীবনযাপনের মধ্যে পরিমিতি আর শৃঙ্খলা না থাকে, তা হলে বাঁধভাঙা বিপদ আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তাই আনন্দে ভেসে গিয়ে আমরা যেন ভুলে না যাই সেই মুখগুলো, যাঁরা অসুস্থতায় কাঁপতে কাঁপতে দুই সপ্তাহ দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন ঘরের কোনায়, এমনকি হাসপাতালের বিছানায়। অন্যান্য বারের মতো সন্ধ্যায় বেরিয়ে গলাগলি করতে করতে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে ভোরবেলায় বাড়ি ফেরার অভ্যাসকে যেন এ বার জলাঞ্জলি দিতে পারি।
মাস্ক পরাটাকে অত্যাচার কিংবা শ্বাস-বন্ধ হয়ে যায় বলে যাঁরা হাহুতাশ করছেন, তাঁদের ভেবে নিতে অনুরোধ করি যে, পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত সংক্রমণ-প্রতিরোধী বস্তু কিন্তু ওই কাপড়ের টুকরোটুকুই। অভ্যাস পরম বস্তু। শুধু তথ্য, জ্ঞান আর উপলব্ধি দিয়েই তা তৈরি হয় না। অনেক প্রয়োজনীয়, কিন্তু আপাত ভাবে অস্বস্তিকর জীবনধারাতে আমরা রপ্ত হয়ে যাই শুধু চর্চা করতে করতে। মাস্কের ক্ষেত্রেও প্রশ্নটা কিন্তু সেই চর্চারই।
এর পাশাপাশি আরও একটা কথা মাথায় রাখা দরকার। কু-অভ্যাসের ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতাটাও কিন্তু ব্যাপক। ভাল অভ্যাসের থেকে হয়তো কিছুটা বেশিই। দেখা যায়, নিয়ম বা রীতি ভাঙার প্রবণতাটির সামাজিক গতি অনেক সময়ই শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকার ইচ্ছে বা প্রবণতার তুলনায় অনেক তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীতে সব দেশেই এমনটা ঘটে থাকে, কোথাও কম কোথাও বেশি।
আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির কথাই ভাবা যাক। এই সংস্কৃতির দিলখোলা অঙ্গন, হৃদয়ের প্রশস্ত বারান্দা যেন প্রতি মুহূর্তে বড় আকাশে ডানা মেলতে চায়। আর তারই পথ বেয়ে বেনোজল হয়ে ঢুকে পড়ে শৃঙ্খলাকে জোয়াল বলে মনে করার অনুভূতি। অর্থাৎ, এটা হল বাঙালির সতত সৃজনশীল সত্তার ‘খরচের দিক’। আমরা কবি হতে চাই, জ্ঞানচর্চা অথবা বিজ্ঞানের পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাই। সৈনিকের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন আমাদের ভাবনায় বিরাট ভার হয়ে দাঁড়ায়। বাধ্যবাধ্যকতার বেড়াজাল ছেঁড়ার একটা স্বাভাবিক ধারা আমাদের মনে বয় ফল্গুধারার মতো। আর এ সব কিছু নিয়েই বাঙালি জীবন এবং সংস্কৃতি দেশে দেশে শিউলি ছড়ায়।
সেই ঐতিহ্যের অনুসারী হিসেবেই আমাদের সাফল্যের ছন্দ প্রতিষ্ঠা করার সময় এবারের পুজো। ছন্দ-পতন আর শৃঙ্খলাহীনতা যে কত বড় বিপদ আনতে পারে, তার প্রমাণ কিন্তু এ দেশের মধ্যেই দেখছি আমরা। উৎসব উদ্যাপন, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমাগমগুলোতে যদি রাশ টানা না যায়, তা হলে দেশে করোনা সংক্রমণের তুষের আগুনে ঘি ঢালার পরিস্থিতি হতে পারে। মহারাষ্ট্রে গণেশ-চতুর্থী পালনের পর ঠিক এমনটাই হয়েছিল। সংক্রমণ ছড়ানোর গতি প্রায় লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছিল পুণে শহরের ঠিক সেই অঞ্চলগুলিতে, যেখানে উৎসবের উন্মাদনা ছিল বেশি। আবার, একই শহরে যে অঞ্চলে উৎসব পালনের মধ্যেও শৃঙ্খলার প্রকাশ ছিল, তারা অনেক ভাল ভাবে উতরে গিয়েছে। যে কেরল সংক্রমণের প্রথম ধাপে সারা পৃথিবীতে আলোড়ন তুলেছিল সামাজিক উদ্যোগ আর প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার যৌথ চেষ্টার সাফল্য হিসেবে, ওনাম উৎসবের কামড় খেয়ে তারাও এখন কোভিডের কাছে নতজানু হয়ে পরিত্রাণের পথ খুঁজছে। আমরা কি সেই আগুনপথে হাঁটব? উল্টোটা করা যায় না?
ধরা যাক, পুজোকে কেন্দ্র করে আমরা যদি মেপে পা ফেলি? সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধিকে আনন্দ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে মেনে নিয়ে পুজোর কয়েকটা দিন পার করতে পারি? তা হলে তা শুধু যে আমাদের আগামী কয়েক মাস ভাল রাখবে তা-ই নয়, আমরা যে শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকতে পারি, তারও একটা উদাহরণ তৈরি হবে। সেই উদাহরণ বাঙালি সংস্কৃতি এবং জাতিসত্তাকে উজ্জ্বল করে তুলবে।
পুজোর উদ্যোক্তাদের কাছে আমাদের আবেদন: এবারের পুজো যদি একটু অনুজ্জ্বলও হয়, সেটাকে আপনারা গৌরব হিসেবে দেখুন। এই উৎসবে মানুষ পুজোমণ্ডপে যাতে কম আসেন, কম সময় থাকেন, দূর থেকে প্রতিমা দেখেন, এ সব সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব আপনিই কাঁধে তুলে নিন। নিয়ম বাঁধে সরকার, কিন্তু নিয়ম প্রতিপালনের মধ্যে যদি স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ না থাকে, তা হলে উৎসবের প্রেক্ষিতে কখনওই তা ফলদায়ী হতে পারে না। উৎসবের অঙ্গনটাকে যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আর সচেতনতার আখড়া বানাতে পারি— একমাত্র তা হলেই এবার আপনার পুজো সেরা পুজো হবে। মা এবার মনে থাকুন, মণ্ডপের হুড়োহুড়িতে নয়। কলাবৌকে স্নান করানো, সিঁদুর খেলা, অঞ্জলি দেওয়া, আর সবার উপরে, বিসর্জনকে কেন্দ্র করে আমাদের যে প্রথাগত হুল্লোড়, তাতে যদি রাশ টেনে রাখতে পারি, তা হলে আমাদের এই কঠিন লড়াইয়ে এখনও পর্যন্ত আসা যতটুকু সাফল্য, সেটা ধরে রাখা সম্ভব হবে। বিশেষ ভাবে দায়িত্ব নিতে হবে কমবয়সিদের। করোনা আক্রমণে সাধারণ ভাবে কম কাবু হলেও, এরা কিন্তু বাড়িতে থাকা বয়স্ক মানুষদের কাছে আগুনের ফুলকির মতো হয়ে উঠতে পারে। এরাই উৎসবে মাতে বেশি, সেটাই স্বাভাবিক। এ বছরটা যে অন্য রকম, তা যদি দামাল কৈশোর ও যৌবনের মাথায় না থাকে, তবে তাদের ক্ষণিকের ফুর্তি বাড়িতে-থাকা মা মাসি মেসোদের অসুস্থতা ও জীবনহানির কারণ হতে পারে।
মনে রাখতে হবে, আমাদের জীবন এখন কাঁথা-মুড়ি দিয়েই পথ হাঁটছে। কোনও শিথিলতার জায়গা নেই সেখানে। খানিকটা সাফল্য এসেছে মাত্র, কিন্তু এই সময় হতাশা আর অদৃষ্টবাদী মানসিকতায় ডুবে আমরা যদি হুল্লোড়ে গা ভাসাই, তা হলে সেটা প্রায় জেতা লড়াইয়ে হেরে যাওয়া হবে। এতটা আত্মসমর্পণ, না কি আত্মোৎসর্গ, না-ই বা করলাম! আশাবাদী থেকে, শৃঙ্খলাবদ্ধ থেকে পুজোর দিনগুলো কাটিয়ে দিলে জীবন থাকবে, জীবিকা থাকবে, আনন্দ থাকবে। হ্যাঁ, আনন্দ তো আসে জীবনকে ঘিরেই।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্থনীতি বিভাগ, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি;
অভিজিৎ চৌধুরী, চিকিৎসক, লিভার ফাউন্ডেশনের সচিব;
সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়, নিউরোবায়োলজি বিভাগ, টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, বেঙ্গালুরু;
সোমক রায়চৌধুরী, অধিকর্তা, ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্স, পুণে